হারিয়ে যাচ্ছে মানবতার দেয়াল
প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
এম এইচ সৈকত
অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তরুণদের হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল মানবতার দেয়াল নামে সামাজিক কার্যক্রম। যদিও দেশের মাটিতে শুরুটা হয়েছিল মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশেই শুরু হয় মানবতার। এই কার্যক্রম দেয়ালে লেখা থাকতো, 'আপনার অপ্রয়োজনীয় জিনিস রেখে যান, প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যান।' কিন্তু আজ সেই মানবতার দেয়াল হারানোর পথে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মানবতার দেয়াল লেখাটা কোনো রকম থাকলেও সেখানে নেই প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়।
২০১৫ সালে ইরানের উত্তর-পূর্বের শহর মাশাদে প্রথম এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেখানে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র পৌঁছে দিতেন। সেই উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর লক্ষ্ণীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল এসসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে এমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট কিশোরগঞ্জের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের 'মহানুভবতার দেয়াল' সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়।
রাজধানীতে ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারের দেয়াল ঘেঁষেই প্রথম এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়।
পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতের সময়ে মানবতার দেয়ালের কাপড়-চোপড়ের কিছুটা দেখা মিললেও পুরো গরমজুড়ে এর কোনো দেখা মিলে না।
বাড্ডা এলাকার একজন বাসিন্দা মারুফ আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমার বাসার সামনে বছর তিন আগে এই উদ্যোগটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই উদ্যোগটি হারিয়ে গেছে। আমি নিজে অনেককেই দেখেছি সেখান থেকে উপকৃত হতে। মাঝে মাঝে আমার কিছু জিনিসপত্র সেখানে রাখতাম। কিন্তু বন্ধ কেন হলো তা আমি জানতে পারিনি।'
রামপুরা আম্বিয়া সার্কেল টাওয়ারের সামনে দোকানদার রিওয়াজ হোসেন জানান, 'আমাদের দোকানের পাশে তরুণরা মানবতার দেয়াল শুরু করেছিল। অনেকদিন বেস দেওয়া-নেওয়ার সমাগম ছিল। কিন্তু এখন দেয়াল থাকলেও নেই জিনিসপত্র। আমার মনে হয় সামনে শীত আসছে হয়তো তখন আবার শুরু হবে।'
সামাজিক এ মহতী উদ্যোগ কেন হারিয়ে যায় সে বিষয়ে কথা হয় হেল্পিং হ্যান্ড বিডির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উদ্যোগটি অসাধারণ। অসহায় মানুষ কারও কাছে হাত না পেতেই প্রয়োজনীয় কাপড় সংগ্রহ করতে পারতো। কিন্তু আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কাপড়গুলো এমনভাবে রাখা হতো যে, বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা ময়লা লেগে নষ্ট হয়ে যেত। আবার অনেকে সব কাপড় এক সঙ্গে নিয়ে বিক্রি করে দিত। এসব কারণেই উদ্যোগটি সফল হয়নি। তবে এ ধরনের উদ্যোগ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে অসহায়, দরিদ্র মানুষ নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে।'
এ বিষয়ে সামাজিক সংগঠন সংস্কারের সভাপতি এম এ খালেক জানান, 'সমাজে এরকম ভালো কিছু উদ্যোগ আমাদের দেশে অচিরেই হারিয়ে যায়। কারণ যে দেশে গুণীজনের কদর নেই সেখানে ভালো কাজের স্থায়িত্ব হয় না, তেমনি ভালো মানুষ তৈরিও হয় না। আমরা প্রায়ই দেখতাম অনেক বেসরকারি চাকরিজীবীরাও এখান থেকে কাপড় নিয়ে উপকৃত হতেন। কিন্তু কিছু মাদকসেবী মানবতার দেয়ালের কাপড় বিক্রি করে নেশায় লিপ্ত থাকতেন। যার কারণে সমাজের ভালো মানুষগুলো এখন কিছু রাখে না। তবে সঠিকভাবে পরিচালনা করা গেলে সমাজের অনেক মানুষই উপকৃত হতেন।'
এ বিষয়ে সরকারি বিএম কলেজের সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর ইসমাইল হোসেন বলেন, 'কাজটি যখন শুরু হয়েছিল তখন মনে হয়েছে আমাদের দেশের তরুণরা অনেক দায়িত্বশীল। যার কারণেই হয়তো এ ধরনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। যখন বিষয়টা হারিয়ে গেল তখন মনে হলো তরুণদের কোথাও কিছু একটা কম আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের অনেক অপ্রয়োজনীয় পোশাক এমনি ফেলে দেই। তরুণদের মহতী উদ্যোগের কারণে তখন সেগুলো আর ফেলতে হতো না। কিন্তু এখন আবার ফেলে দেই। এর কারণ মানুষ বর্তমানে অনেক সম্মান নিয়ে চলে। তাই কারও বাসায় দাওয়াত দিলেও আসতে চায় না, আর পুরাতন পোশাক কি কখনো নিবে।'
উদ্যোগটি হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ভালো কাজ কখনো শেষ হয়ে যায় না। শুরু যেহেতু হয়েছে এর রেশ থেকেই যাবে। তবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা সবাই এগিয়ে আসলে মানবতার দেয়াল সবার কল্যাণে আরও ব্যাপক সাড়া ফেলবে।'
এ বিষয়ে নাগদারপাড় কওমি মাদ্রাসার মুফতি আল আমিন সানী জানান, 'মানুষের উপকার করলে আলস্নাহ অনেক খুশি হন। আমাদের নবী কারীম (সা.) প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ' বছর আগে অনেক হাদিসের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন, অসহায়-অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তিনি নিজেও এ কাজ করতেন। তার সাহাবীদেরও এই নির্দেশ দিয়েছেন। উপকার ছোট হোক বড় হোক সবই আলস্নাহর কাছে সম্মানের। আমি মনে করি মানবতার দেয়াল আবার মধ্যভিত্ত, গরিব-অসহায় মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত হবে।'