রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পঞ্চগড়গামী আন্তঃনগর ট্রেন পঞ্চগড় এক্সপ্রেস লাইনচু্যতির ঘটনায় রেলওয়ের সব ধরনের ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন আসা-যাওয়া বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় যাত্রীদের। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে অনেকেই তাদের নির্ধারিত যাত্রা বাতিল করেন। শুক্রবার সকালে লাইনচু্যত ট্রেনটি উদ্ধার শেষে ট্রেন চলাচল শুরু দুপুর ১২টার পর থেকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে কমলাপুর স্টেশন এলাকায় ট্রেনটি লাইনচু্যত হয়। এতে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে থেকে খবর না পাওয়ায় স্টেশনে হাজির হওয়া হাজার হাজার যাত্রীকে দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তি পোহাতে হয়। যাত্রীদের অনেকেই রাতভর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করেন স্টেশনে। অবশেষে ট্রেনের দেখা না পেয়ে শুক্রবার সকালে অনেকেই তাদের যাত্রা বাতিল করেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) আরিফ মহিউদ্দিন জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে কমলাপুর থেকে ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই 'পঞ্চগড় এক্সপ্রেস'-এর ৫টি বগি স্টেশন এলাকায় লাইনচু্যত হয়। রেললাইন ভেঙে যাওয়ার কারণে ট্রেনের বগিগুলো লাইন থেকে পড়ে যায়। তবে ওই সময় ট্রেনটি খুব ধীরগতিতে থাকায় যাত্রী হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দীর্ঘ চেষ্টার পর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ট্রেনটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রেনটি সাধারণ সময়ের প্রায় আধাঘণ্টা বিলম্বে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ছাড়ে। পস্ন্যাটফর্ম পার হওয়ার ২ মিনিটের মধ্যে ঝাঁকুনি অনুভব হয়। এ সময় ধাতব পদার্থের সঙ্গে ঘর্ষণের শব্দ শুনতে পান তারা। এরপরই ট্রেনটি থেমে যায়। তারা নেমে দেখতে পান বিভিন্ন কোচের লাইনচু্যত হয়েছে। তবে বগিগুলো কাত হয়ে গেলেও বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে থাকা শিডিউল বোর্ডে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার আপডেটে দেখা যায়, ঢাকা থেকে দিনের প্রথম ট্রেন ধূমকেতু এক্সপ্রেস ভোর ৬টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দেখানো হয়েছে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে। দ্বিতীয় ট্রেন পর্যটক এক্সপ্রেস ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দেওয়া হয়েছে সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে। পারাবত এক্সপ্রেস ভোর সাড়ে ৬টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দেখানো হয়েছে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে।
একইভাবে নীলসাগর এক্সপ্রেস ভোর ৬টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দেওয়া হয়েছে সকাল ১০টায়, মহানগর প্রভাতী সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দেওয়া হয়েছে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে এবং সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দেওয়া হয়েছে সকাল ১০টা।
যে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাতে ভ্রমণ করার কথা ছিল পর্যটকদের নিয়ে দেশ ঘুরে বেড়ানো জান্নাতুল ফেরদৌসী মানুর। ২০ জনকে নিয়ে পঞ্চগড়ের পথে রওয়ানা হয়েছিলেন তিনি। ট্রেন ছাড়ার পরপরই বগি লাইনচু্যত হওয়ায় এবং সকাল পর্যন্ত তা ঠিক না হওয়ায় যাত্রা বাতিল করতে হয়েছে তাকে।
শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে জান্নাতুল বলেন, 'কমলাপুর স্টেশন থেকে রাত ১২টায় ট্রেন ছাড়ার দুই-তিন মিনিটের মধ্যে প্রচন্ড শব্দে ধাক্কা খেয়ে ট্রেনটি থেমে যায়। বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বগির মধ্যে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে বের হয়ে দেখি, ট্রেনের কয়েকটি বগি লাইনচু্যত হয়ে গেছে। ট্রেন বা সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো ধরনের তথ্য দিতে পারেননি। কমলাপুর স্টেশনে গিয়েও কোনো তথ্য পাইনি। হটলাইন ১৩১ নম্বরে কল করা হলেও তাদের কাছ থেকেও কোনো তথ্য পাইনি। শেষ পর্যন্ত ভোর ৪টার দিকে সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'সকাল থেকেও নানাভাবে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। রেল কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, ট্রেনটি ছাড়ছে না। যাত্রীদের টিকিট রিফান্ড করে দেওয়া হবে। টিকিটের টাকা হয়তো ফেরত পাওয়া যাবে কিন্তু যাত্রীদের একদিকে ভোগান্তি আরেকদিকে কর্তৃপক্ষের কোনো তথ্য না দেওয়ায় যে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, এর কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না।'
সপরিবারে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার কথা ছিল সাংবাদিক গোলাম সামদানীর। শুক্রবার সকাল ১১টার ঢাকা-সিলেট জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে জয়ন্তিকা ট্রেনটি দুপুর ১২টায়ও কমলাপুরে পৌঁছাতে পারেনি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কমলাপুরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, 'নির্ধারিত সময়ে স্টেশনে চলে এসে শুনি শিডিউল বিপর্যয় চলছে। অনেক ট্রেনই আসেনি। বিভিন্ন গন্তব্যের হাজারও যাত্রী আমার মতো স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। সকাল থেকে হাতেগোনা দুয়েকটি ট্রেন ছেড়ে গেছে। তবে সেগুলোও সময়মতো ছাড়েনি।'
স্টেশন সূত্র জানায়, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা ছেড়ে গেছে। ট্রেনটি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ৭টা। এ ছাড়া তিস্তা ও এগারসিন্দুর দেরিতে হলেও ঢাকা ছেড়েছে।
ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশনের ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলেন, 'আজকের মধ্য শিডিউল বিপর্যয় শেষ হবে। রাত হতে হতে বিপর্যয় কেটে যাবে।' যাত্রীদের সাময়িক অসুবিধার জন্য রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পঞ্চগড়গামী আন্তঃনগর ট্রেন পঞ্চগড় এক্সপ্রেস (৭৯৩)। রেললাইন ভেঙে যাওয়ার কারণে ট্রেনের ছয়টি বগি লাইন থেকে পড়ে যায়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ট্রেনটি ঢাকা ছেড়ে যায়নি। যাত্রীদের সব টিকিট ফেরত দেওয়ার কথা জানিয়েছে স্টেশন কর্তৃপক্ষ।
কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার জানান, সকাল ১০টার দিকে উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের কোচগুলো উদ্ধার করে রাখার কারণে ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর পস্ন্যাটফর্মের লাইন বন্ধ আছে। সেগুলো ক্লিয়ার করার চেষ্টা চলছে।
ট্রেন ছাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'নির্ধারিত সময়ে ট্রেনগুলো ছাড়া যাচ্ছে না। রাত থেকে এখন পর্যন্ত চার জোড়া ট্রেন আসা যাওয়া করেছে। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ আছে। রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের মোবাইলে রাত থেকেই এসএমএস পাঠানোর মাধ্যমে সম্ভাব্য দেরির বিষয়টি অবগত করেছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন বলেন, 'পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের বগি লাইনচু্যত হওয়ায় ট্রেন চলাচলের শিডিউলের বিপর্যয় হয়েছে। তবে এখন যথারীতি ট্রেন আসা-যাওয়া করছে।'
এদিকে, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। বিশেষ করে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কমলাপুর স্টেশনে ভিড় দেখা গেছে। কয়েকজন যাত্রী জানান, ট্রেন ছাড়তে দেরি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বস্ত করেছে যে, ট্রেন দ্রম্নত ছেড়ে যাবে।