পলিথিন নিষিদ্ধ কার্যক্রম

বড় পদক্ষেপে ছোট প্রস্তুতি

বহুবার ব্যবহার উপযোগী ব্যাগ ব্যবহারে দেশের মানুষকে উদ্বুব্ধ করা জরুরি। তা না হলে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের ঘোষণা অতীতের মতোই কাগজ-কলমে গন্ডিবদ্ধ থাকবে

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন জাতীয় সব ধরনের ব্যাগ আগামী ১ নভেম্বর থেকে নিষিদ্ধ এবং কোনো ক্রেতাকে এ ব্যাগ দেওয়া যাবে না। এছাড়া পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ কার্যক্রমে কাঁচাবাজার ও পলিথিন উৎপাদন কারখানায় অভিযান চালানো হবে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ ধরনের বড় পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিলেও এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নায়ারণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তিন হাজারের বেশি পলিথিন কারখানা রয়েছে। সেখানে দৈনিক তৈরিকৃত প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ সারা দেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। পহেলা নভেম্বর থেকে এর ব্যবহার বন্ধ করতে হলে আগেভাগেই বিকল্প ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ওই ব্যাগের ব্যবহারউপযোগিতা এবং মূল্য পলিথিন ব্যাগের সমপরিমাণ হতে হবে। পাশাপাশি একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের পরিবর্তে চট-কাপড় বা অন্য কোনো পচনশীল উপাদানে তৈরি বহুবার ব্যবহার উপযোগী ব্যাগ ব্যবহারে দেশের মানুষকে উদ্বুব্ধ করা জরুরি। তা না হলে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের ঘোষণা অতীতের মতোই কাগজ-কলমে গন্ডিবদ্ধ থাকবে। রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা ও কারওয়ান বাজারসহ প্রায় এক ডজন কাঁচাবাজারের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পহেলা নভেম্বর থেকে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধে সরকারের ঘোষণা শুনেছেন। কিন্তু এর বিকল্প হিসেবে কী ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে কিংবা তা কোথায় কী দরে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য এখনো পাননি। ফলে আর মাত্র এক সপ্তাহ পর সত্যিকার অর্থে বাজার থেকে পলিথিন ব্যাগ উঠে গেলে তাদের বড় ধরনের বিপাকে পড়তে হবে। কেননা ছোটখাটো বাজার-সদাই করার জন্য ক্রেতাদের বাসা থেকে কাপড় বা চটের ব্যাগ নিয়ে আসার ধারা একরকম উঠে গেছে। সদাই নেওয়ার জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে ব্যাগ পাওয়া যাবে- এটি ক্রেতারা ধরেই নিয়েছেন। এদিকে পহেলা নভেম্বর বাজার থেকে পলিথিন তুলে নেওয়ার সরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে ভোক্তারা গণমাধ্যমে অবহিত হলেও আগামীতে বাজারে এর বিকল্প হিসেবে কী পাওয়া যাবে সে বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে। ক্রেতারা অনেকে বাজারে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প খুঁজতে গিয়েও হোঁচট খেয়েছেন। রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, 'পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ পাওয়া যাবে বলে শুনেছিলাম। তবে স্থানীয় বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে কোথাও তা পাইনি। এমনকি তা কোথায় পাওয়া যাবে দোকানিরা তা-ও জানে না।' সারাদেশ থেকে পলিথিন ব্যাগ তুলে দেওয়ার মতো বড় পদক্ষেপ নিতে সরকারের যে প্রস্তুতি তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তিনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকল্প না থাকলে পলিথিন ব্যবহার থেকে সরে আসা কঠিন হয়ে যাবে। যদিও পলিথিনের চেয়ে কিছুটা দাম বেশি হলেও বিকল্প হিসেবে সরকারি উদ্যোগে পাট দিয়ে তৈরি 'সোনালি ব্যাগ' নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এই ব্যাগ এখনো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন সম্ভব হয়নি। অন্তত পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগটি বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হলে পলিথিন ব্যাগ তুলে নেওয়া যেত। কিন্তু পলিথিন ব্যাগ তুলে দেওয়ার তৎপরতা কতটা কার্যকর হবে এবং তা কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে তা নিয়ে সবারই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ কারণে সোনালি ব্যাগ তৈরির জন্য বিনিয়োগ করার মতো উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। রামপুরা বাজারের দোকানি আক্কাস আলী বলেন, পলিথিনের বিকল্প বাজারে কোনো কিছু এলে আমরা সেটা ব্যবহার করব। কিন্তু সেটার দাম পলিথিন ব্যাগের সমান বা সামান্য কিছু বেশি হতে হবে। বিকল্প ব্যাগের দাম ১ টাকার বেশি হলে দোকানিদের পক্ষে তা ক্রেতাদের আগের মতো বিনামূল্যে দেওয়া কঠিন। এ বিষয়টি সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার দোকানি মিরাজ হোসেন জানান, তার প্রতি সপ্তাহে যে পরিমাণ ব্যাগ দরকার তা সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কেউই পর্যাপ্ত বিকল্প কোনো ব্যাগ সরবরাহ করার নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। এছাড়া কাপড়সহ অন্যান্য উপাদানের ব্যাগের কোনোটারই দাম ১০ টাকার নিচে না। সোনালি ব্যাগ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, এই ব্যাগ যদি তিন থেকে পাঁচ টাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হয়, তাহলে বড় দোকানিরা হয়তো তা ক্রেতাদের ফ্রি দিতে পারলেও তবে ছোট দোকানিদের পক্ষে কষ্টকর হবে। পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ তৈরির প্রস্তুতি কতটা তার খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এ উদ্যোগ এখনও 'আঁতুর ঘরে' রয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়টি এখনও বিবেচনা পর্যায়ে রয়েছে। জানা গেছে, আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোবারক আহমেদ খান গবেষণা করে ২০১৭ সালে পাট দিয়ে সোনালি ব্যাগ তৈরি করেন, যা পরিবেশবান্ধব। দেখতেও পলিথিনের মতো। কিন্তু এরপর ৭ বছর পার হয়ে গেলেও পলিথিনের বিকল্প এই ব্যাগ দেশে বাণিজ্যিকভাবে এখনো উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তবে সোনালি ব্যাগের সম্ভাবনার বিষয় নিয়ে ড. মোবারক আহমদ খান সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাকে স্যাম্পলও দিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, 'এটি পলিথিনের উত্তম বিকল্প। এটি এখন সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার চাইলে এটি দ্রম্নত তৈরির ব্যবস্থা করতে পারে। এখানে সরকারের সহায়তা ও বেসরকারি উদ্যোক্তা লাগবে। এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা যারা পস্নাস্টিকের ব্যবসা করেন। বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার নজরে আনা হয়েছে। এখন পলিথিনের বিকল্প না করে আইন করলে তা কার্যকর হবে না। এখন আমাদের টেকনোলজি পুরো প্রস্তুত।' ড. মোবারক আহমদ খান জানান, এখন প্রতি মিনিটে ৬০টি ব্যাগ তৈরি করা যায়। কিন্তু অটোমেটিক মেশিনের মাধ্যমে এর উৎপাদন বাড়বে। এখন প্রতিটি শপিং ব্যাগের দাম পড়ছে পাঁচ টাকার মতো। তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে দাম অনেক কমে আসবে। একই সঙ্গে ব্যাগের গ্রেড অনুযায়ী আলাদা আলাদা মানের তৈরি করা যাবে। তবে শিল্প উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সংগঠন, ব্যাংক ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে সোনালি ব্যাগ উৎপাদন মেশিনারিজ আমদানি করার কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ এমনিতেই কম। এর উপর পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ তৈরির মেশিনারিজ আমদানিতে বিনিয়োগ করার মতো ঝুঁকি এই মুহূর্তে কেউ নিতে চাইবে না। কেননা, অতীতে অনেকবার পলিথিন কারখানা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও পলিথিন কারখানা বন্ধ করা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই সহসাই কারো এ খাতে বিনিয়োগ করার সম্ভাবনা খুবই কম। ব্যাগসহ নানা পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্রিন আর্থ কটেজের সিইও ড. মো. তারেক হোসেইন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগ দিতে হলে প্রতিদিন ৫০ লাখের মতো ব্যাগ প্রয়োজন। যার কাঁচামাল এই মুহূর্তে কারও হাতে নেই। আসলে আগে থেকে কেউ জানতো না এত দ্রম্নত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে সরকার। এজন্য পাটজাত ব্যাগ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল আনার চেষ্টা শুরু করেছে। পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টাও করছে। এদিকে রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ যেসব এলাকায় পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয় ওইসব এলাকা ঘুরে এ কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কারখানা মালিকের সঙ্গে কথা বলেও সে ধরনের কোনো কথা শোনা যায়নি। কারখানা মালিকদের ভাষ্য, অতীতেও বহুবার এ ধরনের হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধু পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাঁদার অংক বেড়েছে। এবারও সেই একই ফাঁদ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন কারখানা মালিক অনেকেই। তবে পহেলা নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারের পাশাপাশি পলিথিন উৎপাদন কারখানায় অভিযান চালানোর ঘোষণায় মালিকরা কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ভাই ভাই পলিথিন কারখানার পরিচালক অনিক বলেন, 'সব সরকারই পলিথিন ফ্যাক্টরি বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। অথচ কেউ আমাদের কথা চিন্তা করে না। আমার কারখানায় ২৫ জন শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে। এখানের উপার্জনে তাদের সংসার চলে। আকস্মিক কারখানা বন্ধ হলে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া কারখানায় মোটা অংকের বিনিয়োগ রয়েছে। পলিথিন নিষিদ্ধ হলে এসব মেশিনারিজ কি হবে- তা সরকারের ভাবা উচিত। সাকিব পলি ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক সাজিদ আজাদ বলেন, এ খাতে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণনের সঙ্গে কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর জীবিকা জড়িত। কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা না করে পলিথিন কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাশাপাশি মালিকরাও পথে বসবে। পলি ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাহিদুর রহমান বলেন, খবরে দেখেছি পহেলা নভেম্বর থেকে পলিথিন ব্যাগ বন্ধে অভিযানে নামবে সরকার। যদি অভিযানে নামে তাহলে বিক্রি কমে যাবে। অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাই পলিথিন বন্ধ না করে বরং কীভাবে পরিবেশ বান্ধব করা যায় তা ভাবতে হবে। অভিযান পরিচালনার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। এদিকে অভিযান চালিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩ হাজারের বেশি পলিথিন কারখানা কতদিনে বন্ধ করা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, অতীতে এ ধরনের অভিযান পরিচালনার সময় পরিবেশ অধিদপ্তর লোকবল সংকটের দোহাই দিয়েছে। এছাড়া কারখানা বন্ধে ও কাঁচাবাজারে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের রুটিন ওয়ার্ক কোনোভাবে চালিয়ে নিলেও তারা এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তাই অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। প্রসঙ্গত, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ বাজারগুলোকে পলিথিনমুক্ত করেছিলেন। দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর তিনি যখন পলিথিন থেকে মুক্তির ঠিক কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন তখন তার সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরও বাজারে তেমন পলিথিন দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকেও পলিথিন ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। পরে ধীরে ধীরে বিগত সরকারের শিথিল নীতির কারণে পলিথিনে সয়লাব হয়ে ওঠে বাজার।