মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সরকারের পথেই হাঁটছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই মাসে দুইবার নীতি সুদহার বাড়িনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯.৫০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে। এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম দফায় নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছিল। তখনো ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে নীতি সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারও কিছু দিন পর পর নীতি সুদহার বাড়াতো। গত বছরের ১৮ জুন নীতি সুদহার ৬ ছিল। জুলাই থেকে সাড়ে ছয় করার ঘোষণা দেয় তৎকালীন সরকার। এক বছরে ছয়বার পরিবর্তন করে সুদহার ৯ শতাংশে রেখে যায়। অর্থাৎ প্রতি দুই মাসে একবার ০.৫ করে নীতি সুদহার পরিবর্তন করেছে। কিন্তু বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কমেনি, উল্টো বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে থাকলেও তা আগের মাসের তুলনায় কমার কথা জানায় বিবিএস। তবে সেটিরও বাজারে কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। বিবিএস বলছে, চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৬৭ শতাংশে। জানুয়ারিতে এটি ছিল
\হ৯.৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ সার্বিক মূল্যস্ফীতি সে হিসেবে তেমন কমেনি।
এ বিষয়ে গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছিলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দুই দফায় নীতি সুদহার বাড়ানো হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ওই বক্তব্যের পরের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। ২৭ অক্টোবর আরেক দফা বৃদ্ধি কার্যকর হবে।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের আমলে টানা দুই মাস মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য দিয়েছিল বিবিএস। তবে চলতি মাসে বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে সরকার কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তাতে ডিমের মতো পণ্যের দাম কিছুটা কমে। তবে বাজারে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের। পণ্যগুলোর দাম কমাতে সরকার শুল্ক-করে ছাড় দিলেও এর সুফল এখনো বাজারে পড়েনি। চারটি পণ্যের দাম আরও বাড়লো এমন সময়ে, যখন বাজারে কোনো স্বস্তি নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পাড়লে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতেও যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা থেকে বেশিরভাগ দেশ বেরিয়ে আসলেও বাংলাদেশে কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আরো নানা বিষয় প্রভাব ফেলেছে। যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে অর্থ পাচার এবং বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা।
দেশে মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে যখন পিষ্ট মানুষ, তখন বিশ্ববাজারে পণ্যের উচ্চ মূল্য দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, এমনিতেই মানুষ শ্লথ প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ ঋণের কারণে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম যে বেড়েছে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এতে মানুষের কষ্ট বাড়বে। এই দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মূল্যের কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন। বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা ভালো অবস্থায় রয়েছে; যদিও তার সতর্কবার্তা, উদ্বেগ এখনো রয়ে গেছে। বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় কিছুটা কম।
আইএমএফ বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি হতে পারে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফের আগের পূর্বাভাস ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতি আগেও ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি। ২০২৫ সালের পর বৈশ্বিক সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
দেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর আগে নিত্যপণ্যের বাজারে এ মাত্রার ঊর্ধ্বমুখিতা এত দীর্ঘ সময় বিরাজ করতে দেখা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বহিঃস্থ বা দেশের বাইরের উপাদানগুলোকে।
এদিকে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসেছে মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর কারণেই। সবশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের মূল্যস্ফীতির গতিবিধি নিয়ে বুধবার 'ইনফ্লেশন ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক নিয়মিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ তিন মাসে হেডলাইন মূল্যস্ফীতির অর্ধেকের বেশি বা ৫১ শতাংশ এসেছে খাদ্যপণ্য থেকে। এর মধ্যে বড় অবদান রেখেছে খাদ্যশস্য ও সবজির মূল্যবৃদ্ধি। এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির বড় প্রভাবক ছিল আমিষ পণ্য, মসলা ও রান্নায় ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় পণ্য। পাশাপাশি চাল, গম ও সবজির দামে ঊর্ধ্বমুখিতারও ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে। এসব পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় জুলাইয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় গত এক যুগে সর্বোচ্চে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠে দাঁড়ায় ১৩ বছরের শীর্ষে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্যের মতো বিষয় রয়েছে। সরকারের মজুত দিয়ে পণ্য বিক্রি করে বাজারের মূল্যকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা কম। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে পুরোপুরিভাবে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এটি করা গেলে বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে আসত যা দাম কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো। ফলে স্থির আয়ের মানুষের জীবনমানের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব অব্যাহত আছে।'