বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে দেশের চার বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বুধবার দুপরে এর আগে দেওয়া ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে নতুন এ সংকেত জানানো হয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র যে গতি-প্রকৃতি, তাতে এর আছড়ে পড়ার সম্ভাব্য এলাকা ভারতের ওডিশার উপক‚ল। এর প্রভাব পড়তে পারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপক‚লীয় জেলা খুলনা ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায়। যদিও ঘূর্ণিঝড়টি ঠিক কোথায় আঘাত হানতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি এলাকায় থাকা ঘূর্ণিঝড় দানা আরও পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়েছে। এটি বুধবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করছিল। এটি আরও পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে এগোতে পারে এবং ঘনীভ‚ত হতে পারে।
আবহাওয়ার বার্তায় বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৫মাছ ধরার নৌকা, ট্রলারগুলোকে দ্রæত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে দেওয়া ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের বার্তায় বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি স্থানীয় সময় বেলা একটার দিকে ওডিশার প্যারাদ্বীপ থেকে ৫৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল। আর পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়টি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা আছে। আজ বৃহস্পতিবার রাত বা পরদিন শুক্রবার ভোরের কোনো এক সময় এটি ওডিশার ভিতরকনিকা থেকে ধামারা বন্দর এলাকা অতিক্রম করতে পারে। অতিক্রম করার সময় এর বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার। এটি সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের ঝুঁকি কোথায়
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ডানার যে গতিবিধি, তাতে এটি ভারতের ওডিশা উপক‚লমুখী। ধামারা বন্দরের দিকেই এটি উপক‚ল অতিক্রম করতে পারে।
বাংলাদেশের উপক‚ল থেকে অনেকটা দূরে হলেও ডানা নিয়ে ঝুঁকি কোথায়, এর উত্তরে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির অতিক্রম করার যে এলাকা, সেখান থেকে বাংলাদেশের উপক‚ল ডানদিকে। আর ডানদিকে থাকার কারণে বাংলাদেশের উপক‚লে এর প্রভাব থাকবে অপেক্ষাকৃত বেশি। বাঁ-দিকে থাকলে সাধারণত কম থাকে।
এর আগে ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশের স›দ্বীপ উপক‚ল অতিক্রম করে। সে সময় এর গতিপথের ডানদিকেই ছিল বাংলাদেশের উপক‚ল।
ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের সময় এর ওপরের বাতাসের গতিবেগ ও ভ‚পৃষ্ঠের গতির পার্থক্য বেশি থাকলে এর শক্তি কম হয়। তবে পার্থক্য কম থাকলে শক্তি বেশি হয়।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ডানা যদি উপক‚ল অতিক্রম করার জন্য দীর্ঘসময় নেয়, তবে এর প্রভাবও দীর্ঘসময় ধরে অনুভ‚ত হবে। আবার বাতাসের গতিবেগ তখন কেমন আছে, তার ওপরও বাংলাদেশের উপক‚লে এর সম্ভাব্য প্রভাব নির্ভর করবে।উপক‚ল জুড়ে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি
এদিকে কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপটি ইতোমধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে, আর তাতেই আতঙ্ক নেমেছে উপক‚ল জুড়ে। ‘ডানা’ নামে এই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে উপক‚লের ঝুঁকিতে থাকা কয়েক হাজার মানুষ। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, সতর্ক অবস্থানে রয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার উপক‚লবাসী বিগত বছরগুলোর দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন করে আবারও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। উপক‚লের অধিকাংশ দুর্বল এবং কাজ চলমান বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। অধিকাংশ এলাকায় বহু আগে নির্মাণ করা এখানকার বেড়িবাঁধগুলো আর পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। তবে এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের ধাক্কা। জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো।
পটুয়াখালীর উপক‚লীয় এলাকায় ২০০৭ সালের আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উপক‚লীয় এলাকাগুলো মধ্য কলাপাড়া উপজেলা একটি। দক্ষিণ অঞ্চলের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে এসব এলাকা খুবই ভয়াবহ অবস্থা হয় ঘূর্ণিঝড়ের সময়।
উপক‚লের চরাঞ্চল এলাকায় বসবাস করা মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের খবরে আতঙ্কে দিন পার করছে। এবং কলাপাড়া উপক‚লীয় এলাকায় বিভিন্ন বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসরত হাজারো পরিবার, দুর্যোগ এলেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন এখানকার মানুষ। দুর্যোগে সাগর এবং নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। দুর্বল বেড়িবাঁধ তাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) কলাপাড়ার ৭নং লতাচাপলী ইউনিয়ন ও কুয়াকাটা পৌরসভার দলনেতা মো. শফিকুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগে ও পরবর্তী সময়ে আমাদের সিপিপি টিমগুলো মাঠে সর্বদা কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে উপক‚লের সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে আমরা মাইকিংয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছি।
পটুয়াখালী জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার জাহান বলেন, বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়ে সেটি ঘনীভ‚ত হয়ে বর্তমানে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে দুই নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সমুদ্রে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা এবং ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপক‚লের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে এমন সংবাদের পরপরই আমরা জরুরি সভা ডেকেছি। এবং এই সভায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হবে। তবে আগের কয়েকটি দুর্যোগে অগ্রিম প্রস্তুতি থাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেছে। আমরা সার্বিকভাবে প্রস্তুত রয়েছি।হাতিয়ার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ বন্ধ
এদিকে নোয়াখালী স্টাফ রিপোর্টার জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে জেলা সদরসহ সারাদেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) দুপুর ২টা থেকে উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন চাকমা। তিনি বলেন, ৩ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত চলার সঙ্গে সঙ্গে নৌ যোগাযোগ বন্ধ রাখতে বলা আছে। একই সঙ্গে মাছ ধরার নৌকাগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে চলতে বলা হয়েছে।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বুধবার ভোর থেকে নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সকাল পৌনে ১১টা থেকে বৃষ্টিপাত ৩০ মিনিট ভারী বৃষ্টি হয়।
জেলা আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক আরজুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলাতে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে। এ কারণে ৩ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এদিকে সকাল থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বন্যায় বিভিন্ন সড়কে যে খাদাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোয় পানি জমে গেছে। এ ছাড়া কিছু নিচু এলাকায় সাময়িক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ বৃষ্টির কারণে বিপাকে পড়েছে খেটেখাওয়া মানুষ।