রাষ্ট্রপতির ভবিষ্যৎ কী
প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
রাষ্ট্র 'সংস্কার' এবং 'ফ্যাসিবাদ' বিতাড়নের হাওয়ায় এবার শেখ হাসিনার আমলে দায়িত্ব পাওয়া রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি প্রবল রূপ নিয়েছে। হাসিনা উৎখাতে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি সংগঠন রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে। বঙ্গভবনের সামনে মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে বিক্ষোভ, নাটকীয়তা। খবর বিডিনিউজ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ওই দাবির কথা বলতে শুরু করেছিলেন অক্টোবরের শুরুতেই। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার 'পদত্যাগের' বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের এক বক্তব্য সামনে আসার পর এখন অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও একই ধরনের ভাবনার কথা বলতে শুরু করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- অন্তর্র্বর্তী সরকার কি চাইলেই রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করতে পারে?
সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা বলছেন, সংসদ যেহেতু কার্যকর নেই, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে থেকে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব না।
তবে তাকে বিদায় করা অসম্ভবও না। তেমন মনে করলে সরকার রাষ্ট্রপতিকে চলে যেতে বলতে পারে। রাষ্ট্রপতি নিজেও পদত্যাগ করতে পারেন। সরকার তখন নতুন কাউকে রাষ্ট্রপতি করতে পারে। তবে বর্তমান সংবিধানে থেকে সেটা সম্ভব নয়।
ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর প্রশাসনের শীর্ষ পদের অধিকারীরা বদলে গেলেও 'অনিবার্য' কারণে রাষ্ট্রপ্রধানের পদে রয়ে গেছেন মো. সাহাবুদ্দিন।
\হবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুলস্নাহ গত ৩ অক্টোবর এক ফেসবুক পোস্টে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি সামনে আনেন। পরে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমও একই দাবির কথা ফেসবুকে বলেন।
এর মধ্যেই নতুন এক আলোচনা ঘিরে সেই দাবি ফের জোরালো হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে উড়ে যাওয়ার আগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন কি না- আড়াই মাস পর হঠাৎ সেই বিতর্ক সামনে এসেছে রাষ্ট্রপতির এক মন্তব্যের কারণে।
আর ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মো. সাহাবুদ্দিন 'শপথ ভঙ্গ করেছেন' দাবি করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মনে করিয়ে দিয়েছেন, এরপরও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে রাখা চলে কি না, তা বিবেচনার সুযোগ সংবিধানে আছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারই রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশনের উদ্যোগ
নেওয়া হয়েছিল। তবে তার আগেই তিনি পদত্যাগ করে ফেলায় সেই পথে আর হাঁটেনি সংসদ।
২০০১ সালের নভেম্বরে বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ২০০২ সালে অপসারণের উদ্যোগ নেয় তখনকার সরকার। সংসদে সেই প্রস্তুতির মধ্যে ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি।
সংবিধানে কী আছে
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।
৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর তার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
৫২ অনুচ্ছেদে সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার সুযোগ আছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে এবং সংসদের কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে।
৫৩ অনুচ্ছেদে শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে অপসারণের যে কথা বলা আছে, সেখানেও সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের শর্ত আছে।
\হশেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন জানানোর পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। ফলে সংসদে অভিসংশনের কোনো সুযোগ এখন নেই বলে মন দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
অপসারণের সুযোগ কোথায়?
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, 'স্বেচ্ছায় পদত্যাগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে এখন অপসারণ করা যাবে না।'
তিনি বলেন, 'যুদ্ধাবস্থা হলে রাষ্ট্রপতি সংসদ পুনর্বহাল করতে পারেন। কিন্তু এখন তো যুদ্ধাবস্থাও নয়।'
আরেক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বা অভিসংশনের আর এখন কোনো আইনি পন্থা নেই। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে করতে পারেন....। সংবিধানে বলা আছে। না, আর কোনো সুযোগ নেই এখন।'
এমনকি এখন রাষ্ট্রপতির অপসারণ বিষয়ে আদালতের মতামত চাওয়ারও কিছু নেই বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, 'আদালতে মতামত চাওয়ার বিষয়টি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। সেটা হলো- কোনো আইন নিয়ে যদি কোনো ব্যত্যয় বা ব্যাখ্যার দরকার হয়, বোঝা যাচ্ছে না- সেখানেই কেবল রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চাইতে পারেন।'
\হসোমবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, 'রাষ্ট্রপতি বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পান নাই, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার, উনার শপথ লঙ্ঘনের সামিল। উনি যদি উনার বক্তব্যে অটল থাকেন, তাহলে উনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকার যোগ্যতায় আছেন কি না, সেটা আমাদের উপদেষ্টামন্ডলীর সবাইকে ভেবে দেখতে হবে।'
উপদেষ্টা পরিষদের কি এ বিষয়ে কিছু করার ক্ষমতা আছে? মনজিল মোরসেদ বলেন, 'ভাবতে পারেন। তবে উপদেষ্টা পরিষদ তো রাষ্ট্রপতির কাছেই শপথ নিয়েছেন। তারা তো রাষ্ট্রপতিকে একসেপ্ট করে নিয়েছেন। ভাববে বলতে তারা দেখবে রাষ্ট্রপতিকে তারা চাচ্ছে কি চাচ্ছে না- এসব নিয়ে ভাবার তো সুযোগ আছে। উপদেষ্টা পরিষদ কেন, যে কোনো মানুষই ভাবতে পারে। যাদের ক্ষমতা আছে তারা ভাবতে পারেন। কিন্তু কিছু করার নেই। রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচ বা অভিসংশন করতে পারবেন অথবা তিনি নিজে পদত্যাগ করতে পারেন। এ দুটোই পদ্ধতি।'
এখন তো সংসদ নেই। তাহলে এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে কীভাবে অপসারণ করা যায়? এ প্রশ্নে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া বলেন, 'পদত্যাগ করতে হবে।'
পদত্যাগ না করলে কী করতে হবে? তিনি বলেন, 'পদত্যাগ করতে বলতে হবে।'
\হসেটা কে বলবে? শরীফ ভুঁইয়া বলেন, 'উপদেষ্টাদের কেউ বলবেন। উপদেষ্টা পরিষদে প্রস্তাব নিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বলতে হবে। এরপর আরেকজনকে রাষ্ট্রপতি করবেন। তাকে প্রধান উপদেষ্টা শপথ পড়াবেন।'
কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা তো সংসদের। এখন সংসদ নেই, তাহলে নতুন রাষ্ট্রপতি হবে কী করে? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এখন তো সাংবিধানিক সরকার নেই। এটা বিপস্নবী সরকার। এখন সবকিছু সংবিধান মেনে চলবে না। কিছু সংবিধান মেনে চলবে, কিছু মেনে চলবে না। সংবিধানের স্পিরিটে কাজটা করতে হবে। এটা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী হবে।'
তবে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, বর্তমানে সংবিধান বহাল থাকায় আইনি বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয় এখন আলোচনা করে লাভ নেই।
গত ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্র্বর্তী সরকার সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকার করেই শপথ নেয়।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলেই বা কী হবে
রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ করেন বা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকেন বা দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তাহলে কী হবে, সেটিও সংবিধানে লেখা আছে।
নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত বা রাষ্ট্রপতি আবার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করবেন স্পিকার।
কিন্তু গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তার অবর্তমানে যিনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেই ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ১৫ আগস্ট।
অবশ্য সংবিধানের ৭৪(৬) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে তখন কী হবে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না বলেন, 'কেন, নতুন রাষ্ট্রপতি ছাত্ররা বানাবে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন, ছাত্ররাই তাকে বানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতিকেও বানাবে।'
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ইতোমধ্যে পদত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পর আর তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন পান্না।