সড়কে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বছরে অন্তত কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন ভয়াবহ এসব দুর্ঘটনায়। প্রাণহানি ছাড়াও চিরতরে পঙ্গু হচ্ছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। আর এসব দুর্ঘটনার মধ্যে সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায়।
পরিসংখ্যান বলছে, মহাসড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃতু্যবরণ করছেন আরোহীরা। শহরগুলোয়ও সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয় মোটর সাইকেলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ, বাইক চালকদের অদক্ষতা ও যাত্রী পরিবহণ এবং এর ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এর বাইরেও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সড়কে বেপরোয়া বাইক চালানোর প্রবণতায় বাড়ছে দুর্ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার অধিকাংশই কিশোর-তরুণ। তারা বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল চালায় হেলমেট পরে না না, রাস্তার কোনো আইন মানে না। ফলে এরা নিজেরাও দুর্ঘটনায় পড়ে, অন্য যানবাহনের জন্যও বিপদ তৈরি করে। বর্তমানে সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনার পেছনে মোটর সাইকেল চালকদের বড় দায় রয়েছে।
এদিকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটর সাইকেল ব্যবহৃত হয়, এমন ১৬টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটর সাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদারের মতে, দেশে মোটর সাইকেলের উৎপাদন ও আমদানি আগের থেকে অনেক বেড়েছে। ফলে কম টাকায় মোটর সাইকেল কিনতে পাওয়া যায়, এমনকি লোনে ও কিস্তিতেও পাওয়া যায়। ফলে মানুষ সামান্য টাকা হলেই এটা কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃতু্যঝুঁকি কত বাড়ছে, সেটা কেউ চিন্তা করছে না।'
এদিকে কিস্তিতে আমদানিকৃত বাইক কেনার সুবিধার পাশাপাশি বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে সংযোজনের কারণে সেসব মোটর সাইকেলের দাম অনেক কমে এসেছে। নিবন্ধন প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। ফলে এখন ২ বছরের নিবন্ধন ফি জমা দিয়ে মোটর সাইকেল রাস্তায় নামানো যায়।
শুধু তাই নয়, মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহণ এখন উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহণের বিকল্প হিসেবে অন্তত ২০ শতাংশ যাত্রী মোটর বাইকে যাতায়াত করে থাকেন। তাই অনেকেই উপার্জনের
পথ হিসেবে মোটরবাইক বেছে নিয়েছেন। যাদের অনেকেরই লাইসেন্স নেই। রয়েছে দক্ষতার অভাবও।
নাম না প্রকাশ করা শর্তে যাত্রীসেবা দেন এমন একজন চালক বলেন, 'আমি চরমভাবে আর্থিক সংকটে পড়ে যাই। তখন ইনকামের আর কোনো পথ না পেয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। এর আগেও আমি মোটর সাইকেল চালিয়েছি। কিন্তু খুব একটা পারদর্শী ছিলাম না। তবে কয়েক মাস চালানোর পর আমার হাত ঠিক হয়ে গেছে। তবে কয়েকবার দুর্ঘটনা ঘটলেও সিরিয়াস কোনো কিছু ঘটেনি।'
রাজধানীতে এমন অসংখ্য চালক রয়েছেন, যারা কোনোমতে বাইক চালাতে পারলেই যাত্রী পরিবহণ শুরু করে দেন। প্রায় একই অবস্থা বিভিন্ন জেলা ও থানা পর্যায়ে। অভিযোগ রয়েছে টাকার বিনিময়েও লাইসেন্স পাচ্ছেন অসংখ্য চালক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন অদক্ষ চালক সড়কে থাকা মানে অন্তত ৫-৬ জন মানুষ ঝুঁকিতে থাকা।
অভিযোগ রয়েছে, মোটর সাইকেল চালকদের বড় একটি অংশের লাইসেন্স নেই। যাদের রয়েছে, তাদের অনেকে সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়াই লাইসেন্স পেয়েছেন। বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। কিন্তু মোটর সাইকেল চালানোর লাইসেন্স রয়েছে ২৩ লাখের মতো। অর্থাৎ ১৩ লাখের বেশি মোটর সাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।
তবে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ১৫ লাখের বেশি মোটর সাইকেল রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশের নিবন্ধনও নেই। এদিকে ঈদসহ বিভিন্ন বড় ছুটিতে মহাসড়কে মোটর সাইকেলের উপস্থিতি বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, গত ঈদে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জনের মৃতু্য হয়। আর নিহতদের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটর সাইকেলের চালক ও আরোহী।
সর্বশেষ অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৯৮ জনের, আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০১ জন।
দেখা গেছে, এই ৯ মাসে ২ হাজার ৪১টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ৯২৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৪.৩৬ শতাংশ। সে হিসেবে প্রায় ৮০ শতাংশ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় একজন মৃতু্যবরণ করেছেন। এবং মোট নিহতের দিক থেকে সব থেকে বেশি।
এ ছাড়া দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১২১ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের প্রায় ২০ শতাংশ। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭৭ ও শিশু ৭২৯ জন। এ ছাড়া যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৮ জন, যা মোট নিহতের ১২.২৯ শতাংশ। নিহতের মধ্যে বাসযাত্রী ছিলেন ২৯৩ জন বা ৫.২৩ শতাংশ, এবং ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি ইত্যাদি পণ্যবাহী যানবাহনের আরোহী মারা গেছেন ৪২০ জন। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে এসব পণ্যবাহী যানবাহনের সম্পৃক্ততার হার ২৩.১৪ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে তা ১০.২৫ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৪.৭৬ শতাংশ এবং থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান ইত্যাদি) ১৬.৪৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার বেশিরভাগ বা ৩৩.৭১ শতাংশ ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে, আঞ্চলিক সড়কে এই হার ৩৮.০৯ এবং গ্রামীণ সড়কে ১৪.০৫ শতাংশ এবং শহরের সড়কে ১২.২১ শতাংশ।