উচ্চ আদালতের আদেশে প্রয়াত বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর পরিচয় নিশ্চিত করতে তার মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরীর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে এসে ডিএনএ নমুনা দেন তিনি।
গত ১৬ অক্টোবর বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর জালালাবাদ এলাকার জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদরাসা কবরস্থান থেকে ডিএন পরীক্ষার জন্য মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করা লাশটি কবর থেকে তোলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় হারিছ চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব।
ওয়ান-ইলাভেনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে আর প্রকাশ্যে ছিলেন না তিনি।
তবে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হারিছ চৌধুরী ৬৮ বছর বয়সে ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। তারপর ঢাকার অদূরে সাভারে একটি মাদরাসায় মাহমুদুর রহমান নামে তাকে দাফন করা হয়। তখন আবার হঠাৎ করেই আলোচনায় আসে হারিছ চৌধুরীর নাম।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর বাবার পরিচয় শনাক্তে মেয়ে সামিরা তানজিম চৌধুরী হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। আদালত লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দেয়।
আদালতের নির্দেশে গত ১৬ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর লাশ উত্তোলন করে নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি।
ডিএনএ নমুনা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বেলা ২টার দিকে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
সামিরা তানজিন চৌধুরী বলেন, 'সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ আমার রক্তের নমুনা নিয়েছে। আমার বাবা মরহুম আব্দুল হারিছ চৌধুরীর মরদেহ উত্তোলন করা হয়েছে। মরদেহ এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর আমার বাবা মরদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপর সিআইডি আজকে আমাকে ডেকেছে, আমার নমুনা সংগ্রহ করার জন্য। এখন আমার ডিএনএর নমুনার সঙ্গে আব্বুর ডিএনএর নমুনা মেলাবে। এরপর সিআইডি ফলাফল দিবে। সিআইডি আমাকে বলেছে, এই প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ হতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগবে।'
ডিএনএ নমুনা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি বলেছি আমার বাবা মারা গেছে, কিন্তু গত সরকার এটা মেনে নেয়নি। তাহলে কি আমার বাবাকে আমি জীবিত রেখে দিব, তা না হলে কাউকে আমার বাবাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার বাবা তো নিরুদ্দেশ থাকতে পারেন না। কোনো ব্যক্তির মৃতু্য হলে এটার একটি সার্টিফিকেট লাগবে। সে তো যেমন তেমন মানুষ ছিল না তার মৃতু্যর বিষয়টা তো প্রমাণিত হতে হবে। যে কোনো যেমন তেমন মানুষেরও মানবিক অধিকার থাকে। আমার আব্বুর মানবিক অধিকার রক্ষা হয়নি।'
ওই সময় হারিছ চৌধুরীর মরদহকে অন্য পরিচয়ে কেন দাফন করা হয়েছিল প্রশ্ন করা হলে সামিরা বলেন, 'আব্বুর মরদেহ আমি আমার দাদুর বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি দেখলাম গণমাধ্যম অহরহ রিপোর্ট করছে মাহমুদুর রহমান নামে হারিছ চৌধুরীর দাফন। এটা আসলে সঠিক নয়। আমার প্রশ্ন, কে মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করেছে?
তিনি আরও বলেন, 'আমি তো শুধু জানি আমি আমার বাবার মরদেহ নিয়ে গিয়েছি সেখানে দাফন হয়েছে। ওখানে যারা দাফন করেছেন তাদের সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি। ওইখানের হুজুর মহিলা মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না, সেটা আমাকে বলা হয়েছিল। আমি তখন সদ্য মৃত বাবার মরদেহ বুকে করে নিয়ে যাওয়া মেয়ে। সে সময় আমি তো কাউকে কিছু বলিনি।'
তিনি বলেন, 'যখন বিষয়টি সবার সামনে আসে, তখন দুইজন সাংবাদিক আমার কাছে বিষয়টি জানতে চান। তখন আমি এ বিষয়ে কথা বলি। আমি তো ওইভাবে কাউকে চিনি না। আমি তাদেরকে বলেছি, হঁ্যা, আব্বু মারা গিয়েছে। আব্বুর দাফন হয়েছে, আপনারা যা শুনছেন তা সত্যি।'
আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে বলেন, 'আগের সরকারের হিংসার পাত্র ছিল আমার আব্বু। তখনকার সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক মামলা হয়েছে। আমার আব্বু গত সরকারের আমলে নির্যাতিত হওয়ার মধ্যে অন্যতম একজন। এ কারণে সে আত্মগোপনে ছিল, কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। তখন ওই সরকারের পক্ষ থেকে অপপ্রচার চালানো হয় যে, হারিছ চৌধুরী লন্ডনে মারা গেছে, আবার কেউ কেউ বলে যে, সে মারা যায়নি, মিথ্যা কথা বলছে, যাতে করে ইন্টারপোল থেকে নাম সরানো যায়। যা ইচ্ছা তাই খবর ছড়ানো হলো আব্বুর মৃতু্যকে কেন্দ্র করে।'
তিনি বলেন, 'মাহমুদুর রহমান নামে আব্বুর মরদেহ কখনই দাফন করা হয়নি। এছাড়া মানবজমিনে আব্বুর মৃতু্যকে নিয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল সেখানেও এই ধরনের কোনো কথা উলেস্নখ করা হয়নি। আমি আমার আব্বুকে মাহমুদুর রহমান বলে দাফন করিনি, আমি আমার আব্বুকে দাফন করেছি। আমি যখন সত্যি কথা বলি তখন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়ে যায়, যাদের মাধ্যমে আব্বুর মরদেহ দাফন করা হয়েছিল। তখন তারা আমার কাছে সার্টিফিকেট চায়। এরমধ্যে মানবজমিনে এ বিষয়ে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশিত হয়ে যায়।'
আপনি আপনার বাবাকে দাফন করেছেন তারপরও এখন ডিএনএ নমুনা দিতে হচ্ছে এই বিড়ম্বনার পিছনে কারা দায়ী, এমন প্রশ্নে সামিরা বলেন, 'এই বিড়ম্বনার জন্য গত সরকার দায়ী। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রশাসন এর জন্য দায়ী। প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি এবং স্বৈরাচারমূলক আচরণের কারণে আমাকে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে।'