এইচএসসি পরীক্ষার ফল পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে একদল শিক্ষার্থী ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন। এতে ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ তুলেছেন বোর্ড কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'সোমবার আমার পদত্যাগপত্র জমা দিবো।' রাত সাড়ে ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বোর্ডের ভেতরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। এদিকে, একই দাবিতে চট্টগ্রাম, কুমিলস্না, যশোর ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ দেখান। তাদের অভিযোগ, 'পরীক্ষার খাতা ঠিকমতো দেখা হয়নি। অ্যাপসের মাধ্যমে আন্দাজ করে রেজাল্ট দেওয়া হয়েছে।' এজন্য ফল পুনরায় মূল্যায়ন করতে হবে। তা না হলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা। গত ১৫ অক্টোবর এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ফলাফল বৈষম্যমূলক বলে অভিযোগ তোলা হয়। এজন্য রোববার দুপুরে 'এইচএসসি ব্যাচ-২০২৪' এর ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে বোর্ডে যান। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল 'বৈষম্যহীন রেজাল্ট চাই'। আন্দোলনকারীরা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে গেটে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা গেট ভেঙে বোর্ডের ভেতরে প্রবেশ করেন। বোর্ড চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের ওপর হামলা করা হয় বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। পরে তারা বোর্ড প্রাঙ্গণেই বিক্ষোভে দেখান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে উত্তীর্ণ আলিফ আহমেদ বলেন, 'সিলেট বোর্ডের শিক্ষার্থীরা একটি পরীক্ষা দিয়েছে, আর আমরা সাতটি পরীক্ষা দিয়েও আমাদের আশানুরূপ রেজাল্ট আসেনি। আমরা আমাদের পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আসলে গেটে পুলিশ বাধা দেয়।' তিনি বলেন, 'একপর্যায়ে গেট ভেঙে আমরা বোর্ড চেয়ারম্যানের রুমে গেলে সেখানে কয়েকজন আমাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে কয়েকজন রক্তাক্ত হয়েছেন।' পরীক্ষার খাতা পুনরায় মূল্যায়ন করা না হলে এই আন্দোলন চলবে জানিয়ে আলিফ বলেন, 'আমাদের পরীক্ষার খাতা ঠিকমতো দেখা হয়নি। তারা অ্যাপসের মাধ্যমে আন্দাজ করে আমাদের রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। আমাদের পরীক্ষার খাতা পুনরায় মূল্যায়ন করা না হলে এই আন্দোলন চলবে।' হামলার ঘটনার বর্ণনায় এক আন্দোলনকারী বলেন, 'আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বোর্ডে এসেছিলাম। আমাদেরকে বাধা দেওয়ায় আমরা জোর করে ঢুকেছি। তারপর বোর্ডের ভেতরের কিছু লোক আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে।' চকবাজার থানার ওসি রেজাউল হোসেন বলেন, 'শিক্ষার্থীরা চেয়ারম্যানের কক্ষে যেতে চাইলে সেখানকার লোকজন তাদের বাধা দেয়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি রয়েছে, সে কারণে বাধা দেওয়ায় ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন আহতের খবর শুনেছি।' ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, 'কিছু ছেলেমেয়ে অটোপাসের দাবিতে এসে আমাদের অবরুদ্ধ করেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কক্ষে প্রবেশের চেষ্টা করে এবং ভাঙচুর করে। যারা আন্দোলন করছে, তারা অকৃতকার্য হয়েছে। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, যেসব সাবজেক্টে পরীক্ষা হয়েছে- তার উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করে ফলাফল দিয়েছি। এখন তারা সেটি মানবে না। তারা চাচ্ছে সবগুলো সাবজেক্ট ম্যাপিং করে নতুন করে ফলাফল দিতে। আমরা তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আশা করি একটা সমাধান হবে।' চট্টগ্রাম বু্যরো জানান, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা আবারও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে পাসের দাবিতে আন্দোলন করেন। রোববার বেলা ১১টা থেকে শিক্ষা বোর্ডের সামনে অবস্থান নিয়ে নানান স্স্নোগান দেন তারা। দাবি মেনে না নেওয়ায় পরবর্তীতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা বোর্ড চেয়ারম্যান ও সচিবের কক্ষের সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় দাবি মেনে নেওয়া না হলে সড়ক অবরোধসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করা এক শিক্ষার্থী বলেন, 'আমাদের ইচ্ছা করেই ফেল করানো হয়েছে। আমরা কোনোভাবে এই ফলাফল মানি না। আমাদের সাবজেক্ট কীভাবে ম্যাপিং হয়েছে; সেই বিষয়ে জানতে চাই। কেননা পরীক্ষা দেওয়ার পরেও কীভাবে অনুপস্থিত আসে?' চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জানিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করব। কুমিলস্না প্রতিনিধি জানান, রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শতাধিক পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কুমিলস্না শিক্ষা বোর্ড প্রাঙ্গণে এসে প্রথমে ফেল থেকে পাসের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এরপর তারা মিছিল নিয়ে শিক্ষা বোর্ডের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরে শিক্ষা বোর্ডের নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশের সদস্যরা তাদের ফটকে আটকে দিয়ে কয়েকজনকে ভেতরে গিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সেখানে বোর্ডের সচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আসাদুজ্জামানসহ বোর্ডের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আসাদুজ্জামান জানান, 'এভাবে আন্দোলন করে ফলাফল পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ২২ অক্টোবরের মধ্যে যেসব বিষয়ে ফেল এসেছে, সেসব বিষয়ে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করতে হবে। কোনো পরীক্ষার্থীর একক কোনো সমস্যা থাকলে, সেটা শিক্ষা বোর্ডের দপ্তরে যোগাযোগ করে এর সমাধান জানতে পারবে। আর সামগ্রিক বিষয়ে লিখিতভাবে বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে।' স্টাফ রিপোর্টার, যশোর জানান, 'মনগড়া ফল' বাতিলের দাবিতে যশোর শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছে এইচএসসি অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা। রোববার দুপুরে শতাধিক শিক্ষার্থী যশোর শিক্ষা বোর্ডে অবস্থান নিয়ে এই বিক্ষোভ করেন। যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, রোববার সকাল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ একদল শিক্ষার্থী শিক্ষা বোর্ডের সামনে অবস্থান নিতে শুরু করে। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার কলেজ থেকে এসব শিক্ষার্থীরা বোর্ড প্রাঙ্গণে জড়ো হয়। দুপুরের দিকে তারা মিছিল সহকারে বোর্ডে প্রবেশ করতে গেলে প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করলে কর্তৃপক্ষ গেট খুলে দেয়। এরপর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় এবং সেখানে বিভিন্ন দাবিসমূহ নিয়ে বিক্ষোভ ও স্স্নোগান দেন। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের নিয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেও তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত অবস্থান ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে তারা ফলাফল বাতিল ও অটোপাসের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এরপর শিক্ষার্থী বোর্ডের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। তবে আন্দোলনকারীদের দাবি 'অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন' বলে জানিয়েছেন যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার। তিনি বলেন, পরীক্ষায় খারাপ ফল করা কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। অল্প কিছু শিক্ষার্থী বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়ে এ ধরনের কর্মকান্ড করছে। তারা পরীক্ষা খারাপ দিয়ে খারাপ ফলাফল করলে বোর্ড কর্তৃপক্ষের তো কিছু করার নেই। তারা আমাদের কিছু লিখিত দাবি জানিয়েছে। বিষয়টি আন্তঃবোর্ডের চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়েছে; আমরা নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, রোববার দুপুরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেন। এর আগে বেলা ১১টায় নগরের টাউন হল মোড়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে এইচএসসিতে অকৃতকার্য শতাধিক শিক্ষার্থী এসে জড়ো হন। সেখানে তারা কিছুক্ষণ অবস্থান শেষে নগরের কাঠগোলা এলাকায় শিক্ষা বোর্ডের কার্যালয়ের দিকে পদযাত্রা করেন। এছাড়া শিক্ষা বোর্ডের সামনের সড়কে ইট ফেলে ও রাস্তায় বসে অবরোধ করেন তারা। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের আলোচনা করেন। পরে শিক্ষার্থীরা পুনরায় এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের জন্য বেলা তিনটার দিকে আবেদন করেন বোর্ডে। আবেদনে বলা হয়, ১৫ অক্টোবর যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তা ত্রম্নটিপূর্ণ ও বৈষম্যযুক্ত। ময়মনসিংহ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের বলেন, 'শিক্ষার্থীদের দেওয়া স্মারকলিপি আমরা আন্তঃবোর্ডে পাঠিয়ে দেব। শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষকদের কারণে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, তা আমরা দেখব। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা পুনর্নিরীক্ষণ করব। আমরা সর্বোচ্চ সহমর্মী হয়েই এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি, কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী অটোপাস দাবি করছে, এটি আমাদের হাতে নেই।'