রিভিউ আবেদনের রায়
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা ফিরল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে
প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করে যে রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সাত বছর আগে দিয়েছিলেন, পর্যালোচনার পর সেই সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া ওই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রোববার শুনানি শেষে কিছু নির্দেশনাসহ তা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন।
এখন কোনো বিচারপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে বা পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ফলে বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে গত সরকারের সময় যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, এই রিভিউ রায়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটল বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হলে সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে টানাপড়েন তৈরি হয়। এরপর এক রিট মামলার রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
২০১৭ সালের ওই রায়েই বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা হয়। তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চের ওই রায় সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের টানাপড়েনে নতুন মাত্রা দেয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও পরে আর শুনানির উদ্যোগ নেয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি অপসারণে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং
রিভিউ আবেদন ঝুলে থাকায় গত সাত বছরে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আর গঠন হয়নি। ফলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরও হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ঝুলে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের 'দোসর' বিচারকদেরও অপসারণের দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে গত সপ্তাহে ১২ জন বিচারককে আপাতত বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন প্রধান বিচারপতি। তখনই ষোড়শ সংশোধনী মামলা ফের আলোচনায় আসে।
আন্দোলনের সূত্র ধরে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদনটি রোববার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানি করেন।
রায়ের পর রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত ধারা বাতিল করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ সেগুলো পুনর্বহাল করেছে।
আর অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, 'এই রায়ের ফলে এখন থেকে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এলে সেই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুইজন বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ওই বিচারপতিকে অপসারণ বা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।'
যে ১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ দেওয়া হয়নি, তাদের ব্যাপারে এখন কী হবে প্রশ্ন করা হলে অ্যাটর্নি জোনরেল বলেন, 'তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আগেও নেওয়া যেত। কারণ আপিল খারিজের পর রিভিউ হলেও স্থগিতাদেশ ছিল না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ক্ষমতা তখনও ছিল।' বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই রায়কে 'ঐতিহাসিক' বলেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল: ষোড়শ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল হওয়ায় বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তির জন্য ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সময় করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরে এসেছে।
ওই অনুচ্ছেদের পুরনো ৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে প্রধান বিচারপতি এবং দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে। কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজে অসমর্থ হন অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধেই যদি তদন্ত চলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।
কাউন্সিলের দায়িত্ব সম্পর্কে ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বিচারকদের জন্য পালনীয় একটি আচরণবিধি কাউন্সিল নির্ধারণ করে দেবে এবং একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে সে বিষয়ে তদন্ত করবে।
৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র থেকে রাষ্ট্রপতি যদি জানতে পারেন যে, কোনো বিচারক শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে পড়েছেন বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে তাহলে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি তদন্ত করে ফলাফল জানানোর নির্দেশ দিতে পারেন।
তদন্ত করার পর কাউন্সিল যদি সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বা তার অসমর্থ্যতার প্রমাণ পায় এবং বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে জানায়, তাহলে ৬ নম্বর দফা অনুসারে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণের আদেশ দেবেন।
৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, তদন্তের ক্ষেত্রে কাউন্সিলই নিজের কর্মপদ্ধতি ঠিক করবে এবং সুপ্রিম কোর্টের মতো ক্ষমতা ধারণ করবে।
প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়।
পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।
পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
সেই পরিবর্তন আসে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। শুনানি শেষে ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারকের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, 'বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে) যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪) ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করা হলো। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো।'
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১৭ সালের ৮ মে আপিল বিভাগের 'ফুলবেঞ্চে' শুনানি শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ আদালতবন্ধু হিসেবে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন। তাদের মধ্যে কামাল হোসেনসহ ৯ জনই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন।
বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ ওই বছর ৩ জুলাই যে রায় দেন, তাতে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল 'সর্বসম্মতভাবে' খারিজ করে দেওয়া হয়।
ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। সেখানে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল এবং ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ নম্বর ধারা পুনর্বহাল করা হয়। তাতেই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সংবিধানে ফেরে।
সেই সঙ্গে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি কার্যকর করতে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফার নতুন একটি আচরণবিধি চূড়ান্ত করে দেয় আপিল বিভাগ।
৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়, ষোড়শ সংশোধনী যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেহেতু ওই সংশোধনীর আগে যে ব্যবস্থা ছিল তা পুনঃস্থাপিত হলো।
তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, 'সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তই যে চূড়ান্ত, তার কারণ এটা নয় যে তা অভ্রান্ত; সেসব সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত, কারণ তা চূড়ান্ত হয়েছে সংবিধানের ভিত্তিতে।'