ভেজাল লুব্রিকেন্টে সয়লাব দেশ
প্রকাশ | ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
এম এইচ সৈকত
দেশে দিন দিন বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। ফলে বাড়ছে তেল-লুব্রিকেন্টের চাহিদা। এই চাহিদাকে পুঁজি করে ক্রেতাদের ঠকিয়ে একটি মহল ভেজাল লুব্রিকেন্ট দিয়ে মাসে কামিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব টাকার ভাগ চলে যাচ্ছে প্রশাসনসহ উচ্চ মহলে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নকল-ভেজাল তেল, লুব্রিকেন্টের ব্যবসার অনুসন্ধানে নেমে মিলছে এসব তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন গাড়ির পুরাতন টায়ার, পস্নাস্টিকের দানা, পোড়া মবিল, কেরোসিন তেল এবং এক ধরনের রিফাইনিং মেডিসিন একত্রে জ্বাল দিয়ে উৎপাদন হচ্ছে নিম্নমানের ও পোড়া রিফাইনিং মবিল বা লুব্রিকেন্ট। এসব নকল-ভেজাল লুব্রিকেন্টের মোড়ক, বোতল ও কোম্পানি একই। অথচ এক দোকান থেকে অন্য দোকানে গেলে ওই একই লুব্রিকেন্টের দাম বোতল বা ক্যানপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা কমে পাওয়া যায়। ফলে ক্রেতাদের চোখে ভালো-মন্দ যাচাই করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ, বসিলা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ, পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল, খাজে দেওয়ান, নিমতলী, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার, ধোলাইখালসহ রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় এই অবৈধ কাজে জড়িত একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ মবিল বা লুব্রিকেন্ট ভেজাল ও নিম্নমানের উপাদান দিয়ে তৈরি। যার ফলে লোকসান গুনছে ভালো মানের লুব্রিকেন্টের কোম্পানিগুলো। আর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এদিকে পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত 'মাসোহারা' দিয়ে ভেজাল মবিল থেকে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যার ফলে ওইসব নকল-ভেজাল তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্টে ব্যবহারের কারণে গাড়ি, মোটর সাইকেল, ট্রাক্টর, ট্রলারসহ বিভিন্ন ইঞ্জিন কিছুদিনের মধ্যেই সমস্যা দেখা দেয়। ফলে যানবাহনের মালিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি বিকল হচ্ছে দামি যানবাহনের যন্ত্রাংশ।
অপরদিকে প্রশাসনসহ
সংশ্লিষ্টদের আশানুরূপ তৎপরতা না থাকার কারণে বছরের পর বছর এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসা করে চলছে একটি চক্র। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন আসলের লেবাসে নকল মবিল তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করলেও সিন্ডিকেট বন্ধ করতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছেন প্রশসানসহ সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দামে একটু কম পেয়ে নকল-ভেজাল তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্টে না বুঝে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এসব নকল-ভেজাল তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্টের কারণে যে কোনো সময় গাড়িতে বিস্ফোরণের শঙ্কা রয়েছে। কারণ, ভেজাল তেল বা ভেজাল লুব্রিকেন্ট তৈরির কারখানাগুলোতে পোড়া লুব্রিকেন্টের ভেতর এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে তা আগের রং ফিরে পায়। এরপর বিভিন্ন দেশের নামি-দামি ব্র্যান্ড নামের ভালো লুব্রিকেন্ট বলে তা বাজরে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ভালো মবিল যাচাই করা ক্রেতাদের কাছে দুষ্কর হয়ে যায়। তাই প্রতরণার হাত থেকে ক্রেতাদের রক্ষা করতে এবং বাজারে ভালো মানের মবিল নিশ্চিত করণে প্রশাসনসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্টে কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, নষ্ট ও পুরনো কালো হয়ে যাওয়া পোড়া মবিল বা অন্যান্য লুব্রিকেন্ট প্রতিলিটার ২০-২৫ টাকা দরে কিনে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যা লুকিয়ে পোড়া মবিল বা লুব্রিকেন্টে কেমিক্যাল দিয়ে রিফাইন করা হয়। পরে আকর্ষণীয় আসল ব্র্যান্ডের পস্নাস্টিকের বোতলে আরবী ও ইংরেজি ভাষায় লেখা এক নম্বর খাঁটি মবিল বা লুব্রিকেন্ট বলে বিক্রি করা হয়। ফলে আসল মবিলের থেকে তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় না বুঝেই ক্রেতাদের কাছে ওইসব ভেজাল মবিলের চাহিদাই বেড়ে যায়। এসব মবিল বেশিরভাগই গাড়ি, মোটর সাইকেল, ট্রাক্টর, ট্রলারসহ বিভিন্ন ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়। অথচ এসব ভেজাল মোবাইল ব্যবহারের কারণে কিছুদিনের মধ্যে ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেয় এবং খুব অল্প সময়ে গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। তাই দেশের সম্পদ রক্ষা করতে এবং ভেজাল মবিল তৈরির সিন্ডিকেট বন্ধ করতে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের আর তৎপর ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তা না হলে খুব শিগগিরই তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্টের ব্যবসায় ধস নামবে।
এ বিষয়ে লুব-রেফ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, লুব্রিকেন্টস অয়েল দেশীয় ও বহুজাতিক ব্রান্ডগুলোর মধ্যে 'বিএনএ' এখন শীর্ষ স্থানে রয়েছে। যার কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সম্মান ধরে রাখতে বাজারে নজর রাখছি। তবে কিছু অসাধু ও সিন্ডিকেট চক্র রয়েছে। তারা বাজারে নামিদামি ব্রান্ডের নাম ব্যবহার করে কাস্টমারদের বোকা বানাচ্ছে। তাই ক্রেতা সাধারণের উচিত, সচেতন হওয়া। একই সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে লুব্রিকেন্ট ক্রয় করা।
এ বিষয়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আব্দুস সোবহান জানান, আমরা টোটাল ব্রান্ড নামে বাজারে লুব্রিকেন্টস দিয়ে থাকি। অনেক সময়ই এ ধরনের অভিযোগ পেয়ে থাকি। তবে আসল লুব্রিকেন্টস ও নকল লুব্রিকেন্টস যাচাই করতে ক্যান ও পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মোড়ক দেখে ক্রয় করতে হবে। এ ছাড়াও শুধু দাম দেখে নয়, মানের যাচাই করে লুব্রিকেন্টে কিনতে হবে। পাশাপাশি প্রতারণা রুখতে সংশ্লিটদের আরও কঠোর হতে হবে।
এ বিষয়ে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. মাসুদুল ইসলাম জানান, ক্যাস্ট্রল নামের লুব্রিকেন্ট দেশের বাজারে অতন্ত সুপরিচিত একটি ব্যান্ড। কিছু অসাধু চক্র পোড়া লুব্রিকেন্টে রিফিল করে বিভিন্ন পরিচিত ব্রান্ডের নামে বাজারে বিক্রি করে যাচ্ছে। এসব লুব্রিকেন্টের গাড়ির ইঞ্জিনের বড় ধরনের ক্ষতি করে। কিছু দিন যেতে না যেতেই দামি গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ক্রেতা সাধারণের অনেক বড় ক্ষতিসাধন হয়। এ ধরনের প্রতারণার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে ক্রেতার পাশাপাশি প্রশাসনের আরও সজাগ দৃষ্টি রাখা। এ ছাড়াও সম্ভব হলে কঠিন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
এ বিষয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. মফিজুর রহমান জানান, লুব্রিকেন্টের দাম একটু কম পাওয়ার আশায় এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যায় ক্রেতারা। এর কারণ হলো একই ব্রান্ডের জিনিস দোকান ভেদে দামের তারতম্য। যার কারণে গ্রাহকরা আসল-নকল লুব্রিকেন্টে চিনতে না পেরে প্রতারণার স্বীকার হয়। আর ক্রেতা সাধারণের সঙ্গে এই প্রতারণা করে যাচ্ছে কিছু অসাধু দোকানি ও সিন্ডেকেট চক্র। তাদের বিষয়ে প্রায়ই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামনেও নেওয়া হবে।