ইসরায়েলের হামলায় হামাস প্রধান সিনওয়ার নিহত

প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ইয়াহিয়া সিনওয়ার
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নজিরবিহীন হামলার 'মাস্টারমাইন্ড' ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নতুন প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সিনওয়ারের মৃতু্যর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সিনওয়ার ২০১৭ সাল থেকে গাজায় হামাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতে, ৭ অক্টোবরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। ওই হামলায় হামাসের বন্দুকধারীরা প্রায় এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা করেছিল ও ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে এসেছিল। এদিকে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাস ইয়াহিয়া সিনওয়ারের নিহত হওয়ার খবরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পশ্চিমা বেশ কয়েকটি দেশ। এ ঘটনাকে ইসরায়েলের অন্যতম বড় সাফল্য বলে মনে করছেন বিশ্ব নেতারা। পাশাপাশি গাজায় যুদ্ধ অবসানের পথ খুলবে বলেও প্রত্যাশা তাদের। খবর বিবিসি। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, বুধবার গাজার রাফাহ শহরের একটি ভবনে অভিযান চালানো হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল যে, ওই ভবনটি হামাসের সিনিয়র নেতারা ব্যবহার করেন। সেই অভিযানে নিহত তিনজনের মধ্যে সিনওয়ার একজন। ওই স্থানে জিম্মির কোনো চিহ্ন নেই। আগে দাবি করা হয়েছিল, জিম্মিদের সুরক্ষার স্বার্থে সিনওয়ার ভ্রমণের সময় তাদের নিজের সঙ্গে রাখবে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেন, 'তিনজন বন্দুকধারীকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়াতে দেখেছে ইসরায়েলি সেনারা। একবার গুলি চালানো হলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ও ইয়াহিয়া সিনওয়ার একা ভবনে প্রবেশ করে।' তিনি আরও বলেন, 'ড্রোন দিয়ে দেখা গেছে, সিনওয়ার একটি চেয়ারে বসে আছেন। ইসরায়েলি সেনারা ভবনে প্রবেশ করে নিহত এই হামাস প্রধানকে একটি ভেস্ট, বন্ধুক ও ৪০ হাজার শেকেলসহ (আট হাজার ২০০ পাউন্ড) দেখতে পায়।' আইডিএফ প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল হার্টজি হালেভি বলেন, 'আমরা বলেছিলাম আমরা তাকে ধরবো এবং তাকে ধরেছিও। তাকে ছাড়া পৃথিবী এখন ভালো।' বিবিসির প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, ইয়াহিয়া সিনওয়ারের দাঁতের রেকর্ড ও আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখার কারণে তার মৃতু্যর খবর নিশ্চিত করতে কয়েক ঘণ্টা দেরি করেছে ইসরায়েল। দেশটির কাছে তার জেনেটিক ডেটা সংরক্ষিত আছে। কারণ, তিনি তার জীবনের কয়েক দশকই কাটিয়েছেন ইসরায়েলের কারাগারে। এর আগে একবার অনলাইনে কিছু গ্রাফিক চিত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, সিনওয়ারের মতো দেখতে একটি মৃতদেহ মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। সে সময় আইডিএফ বলেছিল- তাকে হত্যা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসরণ করা একজনের মৃতু্যর খবর নিশ্চিত না হয়ে বলতে চায়নি তারা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সিনওয়ার হত্যাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, 'যদিও এটি গাজার যুদ্ধের শেষ নয়, এটা শেষের শুরু। এই যুদ্ধ 'আগামীকাল-ই' শেষ হতে পারে, যদি হামাস অস্ত্র ফিরিয়ে দেয় এবং গাজায় আটক বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে দেয়। এর আগে জিম্মিদের পরিবারের উদ্দেশে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, 'যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার প্রিয়জনকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারছি, ইসরায়েল সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়বে। কারণ তারা আমাদেরও প্রিয়জন।' নেতানিয়াহু গাজাবাসীকে বলেন, 'সিনওয়ার আপনার জীবন ধ্বংস করেছে। হামাস আর গাজা নিয়ন্ত্রণ করবে না...এটি হামাসের পরবর্তী দিনের শুরু। অবশেষে হামাসের অত্যাচার থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য আপনাদের একটি সুযোগ।' ইয়াহিয়া সিনওয়ারের এই হত্যাকান্ডের আগে গত জুলাই মাসে তেহরানে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়ে নিহত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হামাসপ্রধান করে হানিয়ের ভূমিকায় বসানো হয়। ৬১ বছর বয়সি সিনওয়ার মূলত আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত। তিনি গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ার খবরের পর বিশ্বনেতারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এ ঘটনাকে ইসরায়েলের অন্যতম বড় সাফল্য বলে মনে করছেন তারা। পাশাপাশি গাজায় যুদ্ধ অবসানের পথ খুলবে বলেও প্রত্যাশা তাদের। এক প্রতিক্রিয়ায় ইয়াহিয়া সিনওয়ার 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাসের নেতা' ও 'হলোকাস্টের পর ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনের নেপথ্যের হোতা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। তিনি বলেন, 'আজ আমি গত বছরের ৭ অক্টোবরে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাব। সিনওয়ারের মৃতু্যতে যুক্তরাজ্য শোক প্রকাশ করবে না। সব জিম্মির মুক্তি, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি- এসবই অনেক দিন ধরে ঝুলে আছে। সুতরাং, আমরা এখন মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই শান্তির পথে হাঁটতে পারি।' যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস উভয়ই ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যাকান্ড নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বাইডেন বলেন, 'আজকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্য এটি একটি শুভ দিন। ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ায় গাজার বুকে হামাসের ক্ষমতার অবসান ঘটবে বলে আশা করি। ফলে বিশ্বে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার সুযোগ তৈরি হবে। এতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ পাবে।' হোয়াইট হাউস জানায়, সিনওয়ারকে হত্যার মিশনে সফল হওয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কীভাবে জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করেছেন তারা। তাছাড়া, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যুদ্ধের সমাপ্তির বিষয়েও তাদের মধ্য কথা হয়েছে। ওদিকে, উইসকনসিনের মিলওয়াকিতে নির্বাচনী প্রচারের সময় কমলা হ্যারিস সাংবাদিকদের বলেন, 'ন্যায়বিচার হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিহত ও গাজায় নিহত জিম্মিসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য সিনওয়ার দায়ী। এই মুহূর্তটি আমাদের গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটানোর একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। আমি আশা করি, হামাসের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আজ একটু হলেও স্বস্তি পাবে।' কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, 'হামাসের নৃশংস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে ইসরায়েলি সেনা সদস্যরা হত্যা করেছে। সিনওয়ারের নেতৃত্বে, হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবরের ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছিল। তিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন এবং সারাদেশে বেসামরিক নাগরিকদের উপর কান্ডজ্ঞানহীন, ধ্বংসাত্মক হামলা শুরু করেছিলেন। এ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে আজ ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পেয়েছে। পাশাপাশি সিনওয়ারের মৃতু্যতে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটেছে।' জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানালেনা বেয়ারবক বলেছেন, 'সিনওয়ার ইসরায়েলের পাশাপাশি দেশটির জনগণকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিনি হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃতু্য এবং পুরো অঞ্চলের দুর্ভোগের জন্য দায়ী। হামাসকে এখনই সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে এবং অস্ত্র ফেলে গাজার মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে তৎপর হতে হবে।' ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেন, 'ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃতু্যর সঙ্গে সঙ্গে গত বছর ৭ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞের প্রধান অপরাধীর শাস্তি হলো। আমার বিশ্বাস, এখান থেকেই নতুন কিছুর শুরু। এখন সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা এবং গাজায় পুনর্গঠন শুরু করার সময় এসেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁও সিনওয়ার নিহতের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি এ ঘটনাকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য বড় সাফল্য বলে উলেস্নখ করে বলেন, 'জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য এ সুযোগকে কাজে লাগানো উচিত।' এছাড়া এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বন্ধ করা জরুরি বলেও মনে করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।