আলমগীর হোসেন ১৩ বছর ধরে ডিমের ব্যবসা করেন। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মালিবাগ রাস্তার ধারেই তার দোকান। এক মাস আগেও তার দোকানে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার ডিম বিক্রি হতো। তবে সোমবার তার দোকানে মাত্র ১২শ' ডিম বিক্রি হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে প্রায় একই অবস্থা চলছে।
রামপুরা বাজারের ডিমের পাইকারি দোকানি শহিদুল জানান, আগে তার দোকানে প্রতিদিন ৩৫-৪০ হাজার টাকার বেচাকেনা হলেও এখন তা কমে ১৬-১৭ হাজার টাকায় এসে ঠেকেছে।
বিক্রিবাট্টা কমার কারণে ঠিকমতো দোকানের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না। মাস শেষে দোকান ভাড়া কোত্থেকে দিবেন, তা নিয়ে রীতিমতো দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন।
শুধু ডিমই নয়, মাছ-মুরগি থেকে শুরু করে সবজি, ফলমূল, ডাল, তেল, চিনিসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বিক্রিতে ভাটার টান ধরেছে। এসব পণ্যের বিক্রেতারা আগে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করতেন, এর থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ মাল কম এনেও নির্ধারিত সময় তা বিক্রি করতে হিমসিম খাচ্ছেন। তাই বিক্রেতারা এখন আগের চেয়ে অর্ধেক কম পণ্য দোকানে তুলছেন। বিশেষ করে পচনশীল খাদ্যপণ্যের বিক্রেতারা আগের সমপরিমাণ মাল দোকানে তোলার ঝুঁকি কোনোভাবেই নিচ্ছেন না। এ ছাড়া বিক্রি কমায় অনেকে দোকানের কর্মচারীর সংখ্যাও কমিয়েছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও পাড়া-মহলস্নার বেশ কয়েকজন মুদি দোকানির সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। তারা জানান, আগে যেসব দোকানে অনায়াসে দৈনিক ১০-১২ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হতো, সেখানে এখন টেনেটুনে ৭-৮ হাজার টাকার বিক্রি হচ্ছে। মাছ-ডিম, মুরগি ও সবজির দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় এসব পণ্য কিনতেই আগের চেয়ে অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। তাই নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সবদিক সামাল দিতে মুদিপণ্য কেনাও
\হখানিকটা কমিয়ে দিয়েছেন।
এদিকে পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমায় মূল্যবৃদ্ধিতেও এর বড় ধাক্কা লাগার কথা বেশিরভাগ দোকানিই অপকটে স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, দোকানভাড়া, কর্মচারীর বেতন, নিজের সংসার খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ের সামাল দিতেই তারা বাধ্য হয়ে কম পরিমাণ পণ্য বিক্রি করেই আগের সমপরিমাণ লাভ করার চেষ্টা করছেন। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাবে পণ্যের দাম বেড়েছে।
মালিবাগ কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা এনামুল জানান, আগে প্রতিদিন গড়ে একশ' কেজি সবজি বিক্রি করতেন। কেজিপ্রতি সবজি কেনা দামের চেয়ে ৭-৮ টাকা বেশিতে বিক্রি করলে দিনশেষে নূ্যনতম ৫০০ টাকা লাভ হতো। তা দিয়ে তার সংসার ভালোভাবেই চলে যেত। কিন্তু মাসেকখানেক ধরে ৫০-৬০ কেজি সবজি বিক্রি করতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো কেজিপ্রতি ৭-৮ টাকা লাভ করলে দোকান চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই কেজিপ্রতি আগের চেয়ে আরও ২-৩ টাকা লাভ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে চড়া দরের পণ্যের দাম আরও কিছুটা বেড়েছে বলে স্বীকার করেন এনামুল।
একই ধরনের তথ্য মেলে মাছ বিক্রেতা রমজান মিয়ার বক্তব্যেও। এই ব্যবসায়ী জানান, আগে প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজি মাছ বিক্রি করলেও বেশ কিছুদিন ধরে এর পরিমাণ ২৫-২৬ কেজিতে নেমে এসেছে। তাই কেজিপ্রতি লাভ আগের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ বাড়াতে হয়েছে। রমজানের ভাষ্য, লাভের পরিমাণ না বাড়ালে ব্যবসার আনুষঙ্গিক খরচ সামাল দেওয়া দুষ্কর হবে। এ ছাড়া চড়া দামের খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য তাদেরও কিনতে হচ্ছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমলে মূল্যস্ফীতিতে এর ধাক্কা লাগবে- এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বিক্রেতারা তাদের দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতনসহ ব্যবসায়িক আনুষঙ্গিক খরচ পুষিয়ে নিতে কম বিক্রিত পণ্যেই আগের সমপরিমাণ লাভ তুলতে চাইছে। বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার নেপথ্যে এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন তারা।
এদিকে আগের তুলনায় খাদ্যপণ্য বিক্রির পরিমাণ কমার চিত্র বাজারে এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত সোমবার শনির আখড়া বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে শরিফ উদ্দিন নামের একজন বীমা কর্মকর্তা সাপ্তাহিক বাজার করতে এসেছেন। তিনি আধা কেজি আলু, আধা কেজি পটল ও এক কেজি কাঁচা পেপে কিনলেও দোকানি আড়াইশ' গ্রাম বরবটি বিক্রি করতে অনীহা দেখাচ্ছেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাক্বিতন্ডা চলছে।
শরিফ উদ্দিনের ভাষ্য, পেঁপে ছাড়া সব সবজির দামই একশ' টাকার আশপাশে। তাই আগে প্রত্যেক আইটেমের সবজি এক দেড় কেজি করে কিনলেও এখন আধা কেজি করে কেনাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দোকনিরা আধা কেজি করে সবজি বিক্রি করতেও কম আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর কোনো সবজি আড়াইশ' গ্রাম কিনতে চাইলে সাফ না করে দিচ্ছে।
তবে সবজি বিক্রেতা কাশেম মিয়ার দাবি, দাম বেশি হওয়ায় তারা আধা কেজি সবজি বিক্রি করতে কোনো ধরনের অনীহা দেখাচ্ছেন না। কিন্তু আড়াইশ' গ্রাম সবজি বিক্রি করতে গেলে অনেক সময় তাদের লোকসান হচ্ছে। কেননা, বেশিরভাগ সবজিই এত কম পরিমাণ পরিমাপ করা কঠিন।
একই বাজারে বাজার করতে আসা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মনির হোসেন জানান, তিনি একশ' গ্রাম আদা কিনতে চাইলে দোকানি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। মনির হোসেনের ভাষ্য, আগে তিনি কখনো এক কেজির নিচে আদা কিনেননি। তবে অগ্নিমূল্যের বাজারে সব সদাই কিনতে গিয়ে পরিমাণ অর্ধেকের চেয়ে কমে নামিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে।
মালিবাগ বাজারে আসা গৃহিণী জেসমিন আক্তার সাথী বলেন, 'সবজির দাম আমাদের নাগালের বাইরে। আগে পটল কিনতাম দেড়-দুই কেজি করে, এখন কিনলাম আধা কেজি। আলু একসঙ্গে কিনতাম ৩-৪ কেজি, আজকে কিনলাম এক কেজি। আমার মতো সবারই একই অবস্থা। নিম্নমধ্যবিত্ত কেউই আগের সমপরিমাণ পণ্য কিনতে পারছে না।
এদিকে আমদানি কমার কারণে ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো বেশকিছু পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি থাকলেও ক্রেতার ক্রয়ের পরিমাণ কমায় এখনো কোনো বড় ধরনের কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি বলে দাবি করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, ক্রেতারা আগের সমপরিমাণ খাদ্যপণ্য কিনলে বিভিন্ন পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে। এতে পণ্যের দাম আরও কয়েকগুণ বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি কমায় নিত্যপণ্যের সরবরাহে চাপ তৈরি হয়েছে। এতে ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম তেল ও পেঁয়াজের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩-৪ শতাংশ বেড়েছে। শুল্কহ্রাসসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামীতে আমদানি আরও কমে নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন তারা।
এদিকে নিত্যপণ্যের আমদানি আগামীতে আরও কমার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন আমদানিকারকরাও। তাদের ভাষ্য, দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা অনেকেই আমদানিতে বড় বিনিয়োগ থেকে সরে এসেছেন। এ ছাড়াও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেকেই বড় চালানে পণ্য আমদানিতে সাহস পাচ্ছেন না।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, ঋণপত্র খোলার আগে দেশে পণ্য আমদানিতে কত খরচ পড়বে এবং স্থানীয় বাজারে দাম কত, এর হিসাব করে পণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্ববাজারে এখন যে দাম, সে তুলনায় দেশের বাজারে পণ্যের দাম কম। আবার ব্যাংকের সুদের হার বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
এদিকে পণ্য আমদানির কারণে সরবরাহ ঘাটতি এবং বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি পুরোপুরি সঠিক নয় বলে মনে করছেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, পণ্য বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে ছোট ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি লাভ আগের তুলনায় কিছুটা বাড়িয়েছে- এটি সত্য। যা সাধারণ মানুষ মেনেই নিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের আকাশচুম্বি দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিই মুখ্য। এ ছাড়াও বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিকেও বিশেষভাবে দায়ী করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, দেশে ৮৭ শতাংশ পরিবার এক জনের উপার্জনে চলে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে নিম্নমধ্যবিত্তের খাদ্যপণ্য কেনার পরিমাণ কমে গেছে। এ জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়িয়েছে। কিন্তু মূল সংকট সেখানে নয়। সরকার নিত্যপণ্যের পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব।
বাজার বিশ্লেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে চাল, শাকসবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামে। ব্যবসায়ীরা এখনো ঠিকমতো এলসি খুলতে পারছে না। এসব কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বরাবরের মতোই সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে নানা কৌশল হাতে নিলেও এর প্রভাব নেই বাজারে। পণ্যের দাম বাড়ার জন্য বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা দায়ী করেছেন সিন্ডিকেটকে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের বাধা কোথায়? আবার অনেকে দাম বাড়ার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং বাজারে চাহিদা ও জোগান সম্পর্কিত তথ্যে স্বচ্ছতার অভাবকে দুষছেন। তবে এর প্রতিটি বিষয়য়ে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করা জরুরি। এতে বাজারের প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।
কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, বর্ষা-বন্যার কারণে দাম হয়ত কিছুটা বাড়ত। তবে যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, সেটা কারসাজি। বাজারে চাঁদাবাজি কমেছে; কিন্তু বন্ধ হয়নি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে প্রাইস কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই কমিশনের কাছেই তথ্য থাকবে, যে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে। এমনকি কে কোন পণ্য আমদানি করল, কতটা বিক্রি করল- এসব তথ্যও তাদের কাছে থাকবে। ফলে কেউ যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারবে না, আবার বাজার সম্পর্কেও একটি পূর্ণ তথ্য-সংবলিত ধারণা সরকারের হাতে থাকবে।
তবে অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজারের সংকট অনেক গভীর এবং ছোটখাটো যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এতে আপাতত কিছুটা লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে ফায়দা হবে না। টাস্কফোর্স জেলাপর্যায়ে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে, সেই তথ্য নিতে পারলে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা কমতে পারে।