১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির

ছাত্রদের হাইকোর্ট ঘেরাও

দলবাজ-দুর্নীতিবাজদের স্থান আদালতে হবে না :সারজিস বৈষম্যবিরোধী আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দলবাজ-দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে বুধবার হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ছাত্ররা (বাঁয়ে) ও বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ -সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের 'ফ্যাসিস্ট' বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগের 'দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ' বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ। আর ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারপতিদের অনতিবিলম্বে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি-লিগ্যাল উইং। বুধবার হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে পৃথকভাবে এসব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এদিকে, আপাতত হাইকোর্ট বিভাগে ১২ বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বুধবার বিকাল চারটার দিকে হাইকোর্টের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভস্থলে এসে এ ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল। তার এ ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট এলাকা ছাড়েন। এর আগে, পূর্বঘোষিত হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালনে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শত শত শিক্ষার্থীর একটি মিছিল আসে। তারা অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের স্থান আদালতে হবে না। অন্যতম আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুলস্নাহ বলেন, 'ফ্যাসিবাদের যারা দোসর ছিল, তাদের দিয়ে আওয়ামী খুনি-সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব নয়।' সারজিস বলেন, 'মামলার রায়ের জন্য কোটি টাকা লেনদেন হয়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশে টাকার বিনিময়ে আসামি খালাস করা বন্ধ করুন। এসব বন্ধ না হলে যেখানেই অভিযোগ পাব, সেখানেই আমরা চলে যাব। দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের কোনো স্থান আদালতে হবে না।' ফ্যাসিস্টদের দোসররা নানা চেহারায় ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করে সারজিস আলম বলেন, 'যখনই এদের কোনো উৎপাত আমরা দেখব, রাজপথে নেমে তাদের প্রতিহত করব। আমাদের দল আলাদা হতে পারে, চিন্তা আলাদা হতে পারে, নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন দলকে আমরা ভোট দিতে পারি। তবে ফ্যাসিস্টদের মোকাবিলায় আমরা সবাই এক।' তিনি আরও বলেন, 'আওয়ামী লীগের সরবরাহ করা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে যে সংগঠনের সন্ত্রাসীরা আমাদের ভাইবোনদের ওপর গুলি চালিয়েছে, হত্যা করেছে, সেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।' সমন্বয়ক হাসনাত আবদুলস্নাহ বলেন, 'ফ্যাসিবাদের যারা দোসর ছিল, তাদের দ্বারা আওয়ামী খুনি ও সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব নয়। তারা যেসব বিচারপতির অপসারণ চান, তাদের নিয়ে বৈঠক হওয়ার খবর তারা পেয়েছেন। যেহেতু বৈঠক চলছে, সে জন্য অনুষ্ঠান ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবেন।' হাসনাত আবদুলস্নাহ আরও বলেন, যারা ক্ষমতায় বসেছেন, বিভিন্ন পদে বসেছেন, তারা ছাত্র-নাগরিকের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে বসেছেন। এ জন্য ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের কোনো চেষ্টা যেন তারা না করেন। আওয়ামী লীগের লোকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন হাসনাত আবদুলস্নাহ। বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা (প্রচারণা) চালাচ্ছে। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ যে ক্ষত রেখে গেছে, তা সারতে সময় লাগবে। আওয়ামী লীগ সব জায়গায় দেশকে 'মাইনাসে' নিয়ে গেছে। সেখান থেকে আগে সমানে আসতে হবে। এরপর উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। ছাত্র-নাগরিকের অভু্যত্থানের সৈনিকদের ঐক্য ভাঙার জন্য কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন হাসনাত আবদুলস্নাহ। বলেন, 'আমাদের ঐক্য ভাঙার জন্য ফ্যাসিস্টরা একেক সময়ে একেক ধরনের টুলস নিয়ে আসবে। কখনো প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো ইংলিশ মিডিয়াম-মাদ্রাসা, কখনো হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের চেষ্টা তারা করছে। কিন্তু আমরা ঐক্য নষ্ট করব না। আমরা বাঁচতে হলে একসঙ্গে বাঁচব, একসঙ্গে লড়াই করব।' হাসনাত আবদুলস্নাহ বলেন, গণহত্যার জন্য আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ক্ষমা চাইতে হবে। ছাত্র-জনতার খুনিদের বিচার করতে হবে। এরপর জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা রাজনীতি করতে পারবেন কি না। এদিকে, বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজের ব্যানারে আইনজীবীরা বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে তারা মিছিলও করেন। বিক্ষোভকারী আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রের ভঙ্গুর অবস্থার জন্য দলবাদ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিরাও দায়ী। এই বিচারপতিরা আওয়ামী লীগের নির্দেশ ও ইচ্ছাকে আইনে পরিণত করেছেন। তাদের জন্যই এত রক্তপাত হয়েছে। শেখ হাসিনা হাজারো ছাত্র-জনতাকে হত্যার সাহস পেয়েছেন। এত মানুষকে গুম, খুন ও হত্যার দায় এই বিচারপতিদেরও। তারা এই বিচারপতিদের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তা করেননি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দোসর বিচারপতিরা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা এই কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। কর্মসূচি চলাকালে আইনজীবীদের নানা স্স্নোগান দিতে দেখা যায়। এসব স্স্নোগানের মধ্যে ছিল 'আইনজীবী-জনতা, গড়ে তোলো একতা', 'দফা এক দাবি এক, দলবাজদের পদত্যাগ', 'ফ্যাসিস্টদের প্রেতাত্মারা, হুঁশিয়ার সাবধান', 'আবু সাঈদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না', 'আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না', 'দফা এক দাবি এক, দুর্নীতিবাজদের পদত্যাগ'। ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এদিকে, আপাতত হাইকোর্ট বিভাগে ১২ বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বুধবার বিকাল চারটার দিকে হাইকোর্টের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভস্থলে এসে এ ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল। তার এ ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট এলাকা ছাড়েন। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা বলেন, 'আপনাদের যে দাবি, আপনাদের যে লিডার, তারা আমার চেম্বারে বসেছিলেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছি। সঙ্গে দুজন সহকর্মী ছিলেন। আপনারা জানেন, বিচারপতির পদত্যাগ বা অপসারণ- এটার একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। একটা সংশোধনী হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। সেটা আবার সরকার রিভিউ আকারে পেশ করেছে। আগামী রোববার ২০ অক্টোবর সেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগে শুনানি হবে। ১ নম্বর আইটেম রাখা হয়েছে সেটি।' আজিজ আহমদ ভূঞা আরও বলেন, 'অন্যদিকে বিচারপতিদের পদত্যাগের আপনাদের যে দাবি, বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের, প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয়, উনি সেটা করেছেন। জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থই হলো, তারা এই যে আগামী ২০ অক্টোবর কোর্ট খুলবে, তাঁরা আর বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। ওই মামলাটির (ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ) শুনানি আছে ২০ তারিখে। অ্যাটর্নি জেনারেল সেটি পেস্নস করবেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে। আর বিচারপতি অপসারণের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট এককভাবে জড়িত নন; রাষ্ট্রপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও আইন উপদেষ্টা জড়িত আছে। আপাতত ১২ জনকে বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।'