বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশ
প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
সম্প্রতি বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। বৃষ্টিনির্ভর আমন মৌসুমে এক ফোটা বৃষ্টির দেখা মেলে না। সেচ দিয়ে আমন চাষ করতে হয়। নদীভাঙনে ও উন্নয়ন কাজে প্রতিদিনই কৃষি জমি কমছে। দিনের পর দিন বৈরী হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী আবহাওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। ধান, গম, আলু. ভুট্টা, সবজি ও মাছে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক বৈরী প্রকৃতিতে খাদ্য উৎপাদনে বিশ্ব উদাহরণ বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এর পরের ৫৪ বছর এখানে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, জলবায়ুর কারণে প্রতিদিন আবাদি জমি কমেছে ২০-৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে চার গুণ বেশি; ভুট্টাসহ এর পরিমাণ সাড়ে ছয় কোটি টন। দেশের খোরপোশ কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে। জিডিপিতে এখন কৃষির অবদান ৪ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। বছরে ২২ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে তাদের খাওয়াতে অতিরিক্ত পাঁচ লাখ টন চালের প্রয়োজন হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ছয় কোটি ৪৩ লাখ টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে। আউশ, আমন ও বোরোতে উৎপাদন হয়েছে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ টন শুধু ধান। ভুট্টা ৪৭ লাখ টন। গম ১১ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। গত ১০ বছর আগেও উৎপাদন ছিল সাড়ে চার কোটি টন। খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ খাদ্য উদ্ধৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ। দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও একটি সিন্ডিকেট দেশে খাদ্যশসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখনো আমদানি নির্ভরতা কমেনি।
বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিশ্বে কৃষিতে ১১ খাতে এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা ২৯ ভাগ আসে কৃষি ও কৃষির উপখাত থেকে। কৃষিকাজে আর কৃষিকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে শতকরা ৬৪ ভাগ মানুষ। বিশ্বে দ্রম্নত খাদ্য উৎপাদন
বৃদ্ধি করেছে- এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার ওপর। বিশেষ করে, খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে উদ্ধৃত্তের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উদাহরণ দেখছে বিশ্ব।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেরও অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো- খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য উৎপাদনে নীরব বিপস্নব বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নীত করেছে। গত ১০ বছরে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। চাল, শাকসবজি ও শস্য উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে এর কিছু রপ্তানিও করা হচ্ছে। কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি রয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল ১০১ কোটি টাকা। খাতওয়ারি যা ছিল সর্বোচ্চ বরাদ্দ। এখন বেসকারি বিনিয়োগকারীরাই কৃষিতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাজেটে কৃষিখাতে সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে। চরম বিরূপ পরিস্থিতি এবং ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, কৃষিপ্রধান দেশে বছরে মানুষের মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৩৪ কেজি। চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দৈনিক ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে। ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, করোনা, টানা দুই বছর খরা ও রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এফএও। বাংলাদেশে খাদ্যের কোনো সংকট হয়নি। নিরাপদ খাদ্যশস্য রপ্তানিতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে দেশে আমন থেকে উৎপাদন হয় দেড় কোটি টন, আউশ হয় ৭০ হাজার টন, বোরো থেকে উৎপাদন হয় দুই কোটি ১৫ লাখ টন, গম উৎপাদন হয় ১২ লাখ টনের বেশি। এ ছাড়া বছরে ভুট্টা উৎপাদন হয় ৫০ লাখ টনের বেশি। দেশে বছরে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে বন্যা, খরা ও জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। অপুষ্টি আর খর্বাকৃতির শিশু জন্ম হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উন্নতি অব্যাহত থাকায় ক্ষুধামুক্তির লড়াইয়ে আরও এগিয়েছে বাংলাদেশ। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। দেশে সবজির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, ভোগ ও রপ্তানিও বেড়েছে। এক সময় 'মাছে-ভাতে বাঙালি' কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিশ্বের ৫৬ দেশে মাছ রপ্তানি হয়। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, এর মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে।
আলু উৎপাদন সাফল্যের এক বিস্ময়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। বর্তমানে দেশে দেড় কোটি টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। আলু বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে পান, বাঁশ ও পাটপণ্য, মাছের কাঁটাসহ অসংখ্য খাদ্যপণ্য।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) বাংলাদেশের কৃষিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা, চালসহ কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত মাছ-মাংস রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে চার দফায় এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর কৃষি বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে আসছেন জ্ঞান অর্জনের জন্য। বৈরী প্রকৃতিতে ফসলের বাম্পার ফলন ফলানো কৌশল শিখতে।
ভূখন্ড ছোট হলেও বৈচিত্র্যে ভরপুর কৃষির এই বাংলাদেশ। আর কৃষির সিংহভাগ দখল করে আছে ধান। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর প্রভাব প্রবল। প্রকৃতপক্ষে, ধান আমাদের জীবনের নিত্য অনুসঙ্গ এবং বলা যায়, গ্রামে এখনো 'ধানই ধন' বলে মনে করা হয়। ১৯৭২ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ১১৭টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ১০৬টি উচ্চফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বৈরী বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা বিনার বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন- যা বিশ্বে সেরা।