ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ

সরবরাহকারীরা সরকার নির্ধারিত দাম মানছেন না, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অভিযানে জরিমানার ভয়ে বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
.

সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে বিক্রির দুই দিন পর ডিমের বাজারে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। সোমবার হঠাৎ করেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিম কিনতে পারছেন না। ভোক্তা পর্যায়ে সৃষ্টি হয়েছে ডিমের সংকট। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে ভোক্তা অধিকার বাজারে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। জরিমানাও করা হচ্ছে। ফলে জরিমানার ভয়ে ব্যবসায়ীরা ফার্মের ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু কেনা দামে বিক্রি করতে না পারায় লোকসানের মুখে তারা ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। ঢাকা অফিস জানায়, গত রোববার থেকেই ফার্মের মুরগির ডিমের বাড়তি দামের মধ্যে বাজারে ডিমের সরবরাহে সমস্যা শুরু হয়। এদিন রাতে রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। রাতে আড়তে ডিমের কোনো ট্রাক আসেনি। এর আগে শনিবার রাতেও খুব কম পরিমাণে ডিম বিক্রি হয়েছে আড়ত থেকে। রাজধানীতে ডিম বিক্রির অন্যতম বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে তেজগাঁও আড়ত। দেশের বিভিন্ন স্থানের খামার থেকে ট্রাকে করে এখানে ডিম আসে। এরপর তেজগাঁও থেকে ঢাকার বিভিন্ন খুচরা বাজার ও পাড়া-মহলস্নায় ডিম সরবরাহ হয়। ফলে তেজগাঁওয়ে ডিম বিক্রি বন্ধ রাখলে সাধারণত খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়ে। রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারে সোমবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বাজারে ফার্মের মুরগির এক ডজন বাদামি ডিম ১৮০ টাকা ও সাদা ডিম ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের সরবরাহ তুলনামূলক কম বলেও জানান বিক্রেতারা। ডিমের পাশাপাশি ফার্মের মুরগির দামও চড়া। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০-২০০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৮০-২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর হাইব্রিড ধরনের সোনালি মুরগির দাম এখন ২৬০-২৭০ টাকা কেজি। দুপুরে কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এই বাজারের কোনো দোকানে ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে না। শুধু একটি দোকানে কয়েকটি লাল ও দুই ডজনের মতো সাদা রঙের ডিম পাওয়া গেছে। এসব ডিমের ডজন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। যদিও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই লাল ডিমগুলো বিক্রি হয়ে যায়। ওই দোকানের ডিম বিক্রেতা ফজুলল হক বলেন, 'ফার্মের মুরগির যে ডিম দেখছেন, তা গতকালের। তা-ও কাঁঠালবাগান বাজার থেকে আনা হয়েছে। তেজগাঁও ডিমের আড়ত থেকে গত দুই দিনে কোনো ডিম কিনতে পারিনি। এর মধ্যে গত রাতে সেখানে ডিম বিক্রি বন্ধ ছিল; আর তার আগের রাতে সরবরাহ ছিল খুবই কম।' গত ১৬ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। বেঁধে দেওয়া দাম অনুসারে, উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে তা ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হয় ১৪২ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে এখন ১৭০-১৮০ টাকায় ডিম বিক্রি হচ্ছে। ডিমের এমন উচ্চ দাম বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডিম উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ডিমের 'যৌক্তিক দাম' নির্ধারণ করেছিল। সরকার নির্ধারিত এই দাম বাস্তবায়ন করতে ডিমের বাজারে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করছে। মূলত অভিযানের ভয়েই ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা। তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উলস্নাহ জানান, সরকার খুচরা পর্যায়ে ডিমের যে দাম নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনছেন তারা। এ কারণে বিক্রিও করতে হচ্ছে বাড়তি দামে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রোববার রাতে তারা পাইকারিতে ডিম বিক্রি করেছেন প্রতিটি ১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এই ডিম তারা কিনেছেন ১২ টাকা থেকে ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে। তিনি জানান, তেজগাঁওয়ে দৈনিক ১৪-১৫ লাখ ডিম আসে। ঢাকায় ডিমের চাহিদা এক কোটি। তেজগাঁওয়ের বাইরে কিছু জায়গায় অনেকে ঠিকই উচ্চ দামে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু তাদের দায়ী করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা। তেজগাঁও থেকে নিয়মিত ডিম কেনেন এমন কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা জানান, তেজগাঁওয়ে ডিমের গাড়ি না ঢুকলে তা শহরেরই ভিন্ন এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়। সোমবার ভোরে এমন কিছু জায়গা থেকে খুচরা বিক্রেতারাও ডিম কিনেছেন। তবে এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রতিটি ফার্মের ডিমের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দিয়েছে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। অথচ ১৩-১৪ টাকার নিচে ডিম পাইকারি আড়তে মিলছে না। খুচরা দোকান কিংবা পাড়া-মহলস্নায় এই দাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে ১৫ টাকায়। এসবের প্রতিবাদে ডিম বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করতে না পারায় গত দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে নগরীর অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার পাহাড়তলী ডিমের আড়ত। সোমবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়তলী পাইকারি ডিমের আড়তের ১৫টি দোকানে ঝুলছে তালা। নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিম কিনতে এসে ফিরছেন খালি হাতে। স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরাও বাধ্য হয়ে বন্ধ রেখেছেন দোকান। পাহাড়তলী পাইকারি বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, গত ৮ দিন ধরে পাইকারিতেই প্রতিটি ডিম ১২ টাকা ৫০ পয়সার বেশি বিক্রি হয়েছে। সেখানে প্রতিটি ডিম গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১২ টাকা ৫০ পয়সায়, ১ অক্টোবর ১২ টাকা ৭০ পয়সায়, ২ অক্টোবর ১২ টাকা ৬০ পয়সায়, ৩ অক্টোবর ১২ টাকা ৮০ পয়সায় এবং ৪ অক্টোবর ১২ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। চট্টগ্রাম ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল শুক্কুর লিটন বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া টাকায় ডিম ক্রয় ও বিক্রি করা যাচ্ছে না। বলা হয়েছে উৎপাদন পর্যায় থেকে ১০ টাকা ৫৮ পয়সায় ডিম কেনা যাবে। কিন্তু বাস্তবে কিনতে হচ্ছে ১৩ টাকার বেশি দামে। এখন আমরা কীভাবে ১১ টাকায় ডিম বিক্রি করব?' কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, 'চট্টগ্রাম নগরে সবচেয়ে বেশি ডিমের আড়ত রয়েছে পাহাড়তলী বাজারে। তারা আড়ত বন্ধ রাখলে এর প্রভাব পড়বে খুচরা পর্যায়ে। এ সময় প্রশাসন, খুচরা-পাইকারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে বসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সমাধানে আসা জরুরি।' জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, 'আমরা পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালিয়ে ডিমের দামে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছি। প্রদর্শিত মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দামে ডিম বিক্রি করায় কয়েকজনকে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়েছে। আমরা অভিযানে গেলেই ব্যবসায়ীদের নিয়ম মেনে ব্যবসা করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এছাড়া ডিমের আড়ত বন্ধ থাকার খবর পাওয়ার পর আমাদের একটি প্রতিনিধি দল পাহাড়তলী বাজারে আড়তে গেছে। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।'