বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা চলছে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। ভর্তিকৃত রোগীদের হাসপাতালের খাবারে খিদে মিটছে না। কারণ পকেটে পর্যাপ্ত টাকা নেই। বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় খাবার তৈরি করে আনার কোনো সুযোগও নেই। তাই রোগীভেদে প্রতিদিন খাবার বাবদ ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তবু রোগী ও রোগীর স্বজনরা পেটে খিদে নিয়েই ঘুমাচ্ছেন শয্যায় ও মেঝেতে।
গত বুধবার সরেজমিন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ডের রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে রোগীর প্রয়োজনী ওষুধও হাসপাতাল থেকে দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হচ্ছে। সিটি স্ক্যান ও এমআরআইসহ অন্যান্য জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হচ্ছে বাহির থেকে। এতে রোগীর স্বজনদের ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে সকালে ৪ পিস পাউরুটি, ১পিস কলা, ১ পিস ডিম ও পাউডার দুধ জ্বাল দিয়ে ১ কাপ তরল দুধ দেওয়া হয়। দুপুরে ও রাতে দেওয়া হয় ছোট ১ পিস মাছ অথবা মাংস, সঙ্গে লাউ সবজি ও ডাল। যে পরিমাণ ভাত দেয় সেই ভাত ও তরকারি দিয়ে খাওয়া যায় না। প্রতিবেলা বাহির থেকে কিনে খেতে হয়।
রোগী ও স্বজনরা আরও জানিয়েছে, হাসপাতালে নিচতলায় ও বিভিন্ন ওয়ার্ডের প্রবেশ মুখে আগে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি থাকত। সে সময় তারা দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার দিত। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফল দেওয়া হতো। এখন তারা আর বসে না। আমরাও হাসপাতালের বাইরের কোনো খাবার পাই না। এছাড়া আগে হাসপাতালে এসে অনেকে সাহায্য সহযোগিতা করত। এখন কেউ আসে না। কারণ হাসপাতাল পরিচালকের অনুমতি ছাড়া এখন কেউ ওয়ার্ডে আসতে পারেন না।
বাড্ডার শাহজাদপুর এলাকায় একটি মেছে ভাড়া থাকতেন বরিশালের মো. হুমায়ন কবির খানের ছেলে শাহাদত হোসেন খান। শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন ইনটেরিয়র
ডিজাইনের একটি প্রতিষ্ঠানে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হাতে কোনো কাজ না থাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। ৪ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিতে বাংলামোটর এলাকায় আসেন। সেখান থেকে কারওয়ান বাজারের দিকে এগোচ্ছিলেন। সে সময় থেমে থেমে শিক্ষার্থী জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। যখন কারওয়ান বাজার ডেইলি স্টার পত্রিকার অফিসের সামনে আসেন তখনই গুলিবিদ্ধ হন। দুটি গুলি লাগে ডান পায়ের উরুতে। একটি গুলি উরুর মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায়। অন্যটি পায়ের উরুর হাড় ভেঙ্গে চুড়মার করে দেয়। সেই থেকে চিকিৎসা চলছে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে। বর্তমানে এ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় বিশেষায়িত এ ওয়ার্ডে ১২ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।
আহত শাহাদত হোসেন খান হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'হাসপাতাল থেকে যে ব্যথার ও গ্যাসের ওষুধ দেয় তাতে ব্যথাও কমে না, পেটের গ্যাসও যায় না। আমি এখন ওষুধ বাহির থেকে কিনে খাই। হাসপাতালের খাবার তো খাইতেই পারি না। ২ মাসের মধ্যে এই খাবার ৩/৪দিন খাইছি। সব সময় বাইরে থেকে খাবার এনে খাইতে হয়।'
পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয় তলায় বিশেষায়িত এ ওয়ার্ডে ১০ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধী মনির হোসেন। ২০ জুলাই সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর চৌরাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন। মনির হোসেনের ভাই রানা মিয়া বলেন, 'আমাদের বাড়ি বরিশাল। মনির চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে থাকত গাজীপুর। এখন আমি আমার বাবা, মনিরের স্ত্রী ও সন্তান সবাই হাসপাতালে। এখানে সবার খাবার খরচ হিসাব করলে প্রতিদিন ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ হয়। বাড়ি থেকে খাবার আনা সম্ভব না। কারণ আমাদের বাড়ি। অনেক দূরে।'
ইব্রাহীম হাওলাদার ও ফিরোজা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট নাদিম হাওলাদার। ১৮ বছর বয়সের নাদিম ১৫ বছর আগে বাবাকে হারায়। মা ও বোনকে নিয়ে থাকতেন চিটাগাং রোডে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে ভাড়া বাসায়। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার শুরু করলে মা বোনের দেখাশুনোর দায়িত্ব বর্তায় এই নাদিমের ঘাড়েই। অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সময় ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে আহত হয়। বর্তমানে চিকিৎসা চলছে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে জরুরি বিভাগের তৃতীয় তলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের বিশেষায়িত বি ওয়ার্ডের (পুরুষ) ৪ নম্বর শয্যায়।
নাদিম হাওলাদারের মা বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম বলেন, 'এই হাসপাতালে চিকিৎসা বিনামূল্যে পাচ্ছি। আগে ছাত্ররা এক বেলা ভাত খাবার দিত। এখন তারা কোনো খাবার দেয় না। আমাদের প্রতিদিন বাইরে থেকে ৩০০-৩৫০ টাকার মতো খাবার কিনতে হয়।'
মো. রাকিব উদ্দীন উত্তরা হাইস্কুল এন্ড কলেজ থেকে চলতি শিক্ষাবর্ষে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরিবারের সঙ্গে উত্তরা ফায়দাবাদ এলাকায় থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই উত্তরা আজমপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচে বিকাল ৫টায় গুলিবিদ্ধ হন। গুলি খেয়ে পরে যাওয়ার পর টানাহেঁচড়া করায় হাতের কনুই ও হাঁটুতে ছিলে জখম হয়। পরে উপস্থিত ছাত্রজনতা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
প্রথমে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ১৯ জুলাই তারিখে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। যেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পুনরায় পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে রক্তঝরা বন্ধ না হওয়ায় ৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় এবং চিকিৎসা শেষে পুনরায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয়।
আহত রাকিব উদ্দিনের মা নার্গিস বেগম বলেন, 'দুই মাস পার হলো এখনো রাকিব চলাফেরা করতে পারে না। পঙ্গু হাস্পাতালে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। চিকিৎসকরা অসহযোগিতা করেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে বাম হিপ জয়েন্টের সিটি স্ক্যান করাত দেওয়া হয়। এই সিটি স্ক্যান করতে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে সিরিয়াল না পেয়ে বাহির থেকে করেছি। এই পরীক্ষা করার পরে মূল সমস্যা ধরা পড়ে। এখন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।'
তিনি আরও বলেন, 'হাসপাতাল থেকে দেওয়া সকালে খাবার একেবারেই কাজে আসে না। আজ সকালে বাহির থেকে দুটি নানরুটি ২০ টাকা, ১ পিস মাংস ১০০ টাকা ও দুই কাপ চা ৩০ টাকা দিয়ে কিনে এনে মা ছেলে সকালের নাস্তা করেছি। এতে দেড়শ' টাকা খরচ হয়েছে। এর বাহিরে দুপুর ও রাতে একজনের খাবার কিনে হাসপাতালের খাবারের সঙ্গে মিলিয়ে দুইজনে খাই।'