বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এলাকায় নোঙর করে রাখা তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসবাহী (এলজিপি) বহনকারী 'এলপিজি সোফিয়া' ও 'ক্যাপ্টেন নিকোলাস' নামে দুটি লাইটারেজ জাহাজে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে এ ঘটনার সোয়া ১১ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে অগ্নিনির্বাপনী ও উদ্ধারকারী দল। কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী দল জাহাজে থাকা ৩১ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করেছে। এ ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে রোববার বিকাল পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।জানা গেছে, ক্যাপ্টেন নিকোলাস ট্যাংকারে করে মোট ৪২ হাজার ৯২৫ টন এলপিজি বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস আমদানি করেছে পাঁচ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি ট্যাংকারে গত শুক্রবার ৩ হাজার ২৫০ টন এলপিজি স্থানান্তর করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় স্থানান্তর করার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সাগরে ভাসমান নাবিকদের উদ্ধারকাজে সহায়তা করে টাগবোট 'তুফান এক্সপ্রেস'। টাগবোটের মাস্টার নজরুল ইসলাম জানান, 'আগুন লাগার পর প্রথমে জাহাজে থাকা অগ্নিনির্বাপণকারী ইকু্যইপমেন্ট দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন নাবিকেরা। পরে ক্যাপ্টেনের নির্দেশে জীবন বাঁচাতে নাবিকরা তিনটি গ্রম্নপে ভাগ হয়ে সাগরে ঝাঁপ দেন। ৩১ জনকে উদ্ধার করে আমাদের টাগবোট রোববার সকালে পতেঙ্গা উপকূলে পৌঁছে দিয়েছে।'
কোস্টগার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি জানান, 'গভীর সাগরে নোঙর করা ওই জাহাজে হঠাৎ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়।
সুফিয়া জাহাজের পাইলট ছিলেন আন্তর্জাতিক নৌ রুটের দক্ষ নাবিক বাঁশখালীর সন্তান ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ। তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তিনিসহ বাকি সহকর্মীরা নিরাপদে আছেন। তিনি ছাড়াও জাহাজটিতে এক ইন্দোনেশিয়ান চিফ অফিসারসহ ভারতীয় ও বাংলাদেশি ক্রু ছিলেন।
নৌবাহিনী জানায়, বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া অ্যাঙ্করেজের দক্ষিণে অবস্থানরত এলপিজি বহনকারী লাইটারেজ জাহাজ সুফিয়ার আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে নৌবাহিনীর পাঁচটি অত্যাধুনিক জাহাজসহ কোস্টগার্ডের দুটি জাহাজ ও চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ। মধ্যরাতে আগুন লাগার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বহির্নোঙ্গরে টহলে থাকা নৌবাহিনী জাহাজ শাপলা। পরে নৌবাহিনীর আরও চারটি জাহাজ ও কোস্টগার্ডের দুটি জাহাজ আগুন নিয়ন্ত্রণে যুক্ত হয়। এ ছাড়া জাহাজটিতে থাকা ৩১ জন ক্রুকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের মেডিকেল দল।
জাহাজের সিনিয়র নাবিক আতিক ইউ খান জানান, 'লাইটারিং অপারেশন শেষে এলপিজি ক্যারিয়ার্স 'বি-এলপিজি সোফিয়া' মাদার ভেসেল নিকোলাস থেকে আলাদা করার সময় অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়।
এদিকে, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর এম ফজলার রহমানকে। এ ছাড়াও কমিটিতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ তথা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, 'শনিবার রাতে কুতুবদিয়া উপকূলের লাইটার জাহাজ সুফিয়া এবং মাদার ভেসাল ক্যাপ্টেন নিকোলাস নামে দুটি জাহাজে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীসহ চট্টগ্রাম বন্দরের টাগবোট। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৫ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।'
তদন্ত কমিটির প্রধান কমডোর এম ফজলার রহমান বলেন, 'জাহাজ দুটির দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে গঠিত কমিটি কাজ শুরু করেছে। আমরা ইতোমধ্যে ওইসব জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া ক্রুদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বক্তব্য নিয়েছি। সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করব। আরও এ সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের সঙ্গেও কথা বলব।'
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, 'গভীর সাগরে নোঙর করা জাহাজে আগুনের খবর প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডকে জানানো হয়। ঘটনাস্থলে নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ড কাজ করছে।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন 'বাংলার জ্যোতি' নামে একটি অয়েল ট্যাংকারে বিস্ফোরণের পর আগুন লাগে। ওই ঘটনায় তিন জনের মৃতু্য হয়। এরপর ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে 'বাংলার সৌরভ' নামে আরেকটি তেলবাহী জাহাজে আগুন লাগে। দুটি জাহাজই রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন।