কুমারী পূজায় মাতৃবন্দনা
প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
মাতৃশক্তির বন্দনা করে শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমী তিথিতে কুমারী রূপে দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। প্রতি বছরের মতো এবারও সবচেয়ে বড় পরিসরে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজধানীর গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে।
শাস্ত্রমতে, মানববন্দনা, নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং ঈশ্বরের আরাধনাই কুমারী পূজার শিক্ষা। যে ত্রিশক্তিতে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়ের চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই শক্তি কুমারীতে বীজ আকারে আছে বলে বিশ্বাস করেন সনাতন ধর্মানুসারীরা। এই বিশ্বাসেই তারা কুমারীকে দেবী দুর্গা হিসেবে আরাধনা করেন।
এদিকে, দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীতে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সকাল
থেকে রামকৃষ্ণ মঠ প্রাঙ্গণ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্ত ও অনুসারীদের আগমনে মুখরিত। এ দিন কুমারী পূজার আগে সকাল ৬টা ১০ মিনিটে মহাঅষ্টমী পূজা শুরু হয়। সকাল ১০টায় হয় পুষ্পাঞ্জলি।
হিন্দু শাস্ত্রমতে অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাস- এই পাঁচ উপকরণে দেওয়া হয় 'কুমারী' পূজা। এই পূজা চলে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। পূজার অর্ঘ্য প্রদানের পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য। দেবী মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পরে হয় প্রসাদ বিতরণ।
পূজার সময় পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের ফাঁকে ফাঁকে বাজানো হয় ঢাক-ঢোলের বাদ্য, কাঁসর-ঘণ্টা ও শঙ্খ। এ সময় ভক্তরা উলুধ্বনি দেন এবং কুমারী দেবী ও দুর্গা দেবীর জয়ধ্বনি করেন।
পূজার কার্যক্রম শেষে কুমারী মায়ের নাম জানান রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মহারাজ। তিনি বলেন, এ বছর কুমারী মা হয়েছেন সংহিতা ভট্টাচার্য। তার বয়স ৮ বছর, জন্ম ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। শাস্ত্রমতে এ দিন তার নামকরণ করা হয় কুবজিকা।
সংহিতার বাবার নাম সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মা অর্পিতা ভট্টাচার্য। কক্সবাজারের রামুর একটি স্কুলের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী সংহিতা। ঢাকার রামপুরার বনশ্রী এলাকায় তাদের বাসা।
স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ আরও বলেন, 'আমরা নিরাপত্তার বেড়াজালে পূজা করিনি। খুব স্বাচ্ছন্দ্যভাবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূজা করেছি। আমরা কোনো নিরাপত্তার অভাব অনুভব করিনি। খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এখানে কুমারী পূজা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।'
আর কুমারী দেবী সংহিতা ভট্টাচার্য বলে, 'আমি সবাইকে আশীর্বাদ করেছি। সবার কল্যাণ হোক।'
১৯০১ সালে ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার বেলুড় মঠে কুমারী পূজার ঐতিহ্য সূচনা করেছিলেন। সেবার দুর্গাপূজার সময় স্বামী ৯ জন কুমারীকে পূজা করেছিলেন। তখন থেকে প্রতি বছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। পূজার আগ পর্যন্ত কুমারীর পরিচয় গোপন রাখা হয়। এ ছাড়া নির্বাচিত কুমারী পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন আচার-অনুষ্ঠান করতে পারে। শাস্ত্র অনুসারে, সাধারণত ১ থেকে ১৬ বছরের সুলক্ষণা কুমারীকে পূজা করা হয়। তবে যতটা কম বয়সিকে করা যায়, সেটাই ভালো।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা কুমারী কন্যাকে মাতৃভাবে জীবন্ত প্রতিমা কল্পনা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে কুমারী পূজা করেন। ভক্তদের মতে, এ পূজা একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা আর নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। নারীর সম্মান, মানুষের সম্মান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজার অন্তর্নিহিত শিক্ষা।
এদিকে, শুক্রবার সকালে মতিঝিলের ইত্তেফাক মোড় থেকে গোপীবাগমুখী রামকৃষ্ণ মিশন রোডে ঢুকতেই ঢাক-ঢোলের আওয়াজ কানে আসছিল। থেমে থেমে বাজছিল ঘণ্টা, কাঁসা ও শঙ্খ। সড়ক থেকেই কুমারী পূজায় যাওয়া হাজার হাজার ভক্তের ভিড় দেখা যায়। দীর্ঘ লাইন ধরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মিশনের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ভক্তরা উলুধ্বনি দিচ্ছেন।
পূজা শুরুর আগে পর্দায় ঢাকা মন্ডপে অধিষ্ঠিত করা হয় 'কুমারী মাকে'। পরে খুলে দেওয়া হয় পর্দা। তখন হাজারো ভক্ত জয়ধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নেন। লাল শাড়ি পরে আসা কুমারী মায়ের দুই হাতে ছিল হাতে দুটি পদ্মফুল।
হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন 'কন্যারূপে' ধরায় আসেন দশভুজা দেবী দুর্গা, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই 'আগমন ও প্রস্থানের' মধ্যে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।
এবার দেবী দুর্গার আগমন হয়েছে দোলায় বা পালকিতে এবং গমন ঘোটক বা ঘোড়ায়। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি বলেছে, এবার সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্ডপ ও মন্দিরে দুর্গাপূজা হচ্ছে। গত বছর ৩২ হাজার ৪০৮টি মন্ডপ ও মন্দিরে দুর্গাপূজা হয়েছিল। আর এবার ঢাকা মহানগরে ২৫২টি মন্ডপ-মন্দিরে দুর্গাপূজা হচ্ছে। গত বছর ঢাকা মহানগরে ২৪৮টি মন্ডপ-মন্দিরে পূজার আয়োজন করা হয়েছিল।