সুদের টাকায় চলছে চিকিৎসা

সুদের টাকায় চলছে চিকিৎসা

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

পাঠান সোহাগ
মায়ের সঙ্গে নাদিম হাওলাদার
'সুদের টাকায় চলছে ছেলের চিকিৎসা। এ জন্য ৫০ হাজার টাকা সুদে ধার নিয়েছি। একদিকে চিকিৎসার খরচ, অন্যদিকে সুদের টাকা শোধের চিন্তায় এখন আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।' পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এ কথাগুলো বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত নাদিম হাওলাদারের বৃদ্ধা মা ফিরোজা বেগম। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চতুর্থ তলার বারান্দায় এই প্রতিবেদকের কথা হয় ফিরোজা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ছেলে ভাড়ায় অটোরিকশা চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল। আরও কিছু ধারদেনা করে ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে একটা অটো কিনে দেই। চিকিৎসার জন্য সেই অটো ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে এই টাকা যখন শেষ হয়ে গেছে তখন কারো কাছে কোনো সাহায্য-সহযোগীতা পাইনি। এমনকি ধার দেওয়ার মতো কাউকে পাইনি। পরে বাধ্য হয়ে টাকা এক আত্মীয়র মাধ্যমে সুদে ঋণ নিয়েছি।' বরিশালের ঝালকাঠি জেলার ইব্রাহীম হাওলাদার ও ফিরোজা বেগম জীবন জীবিকার তাগিদে রাজধানীর চিটাগাং রোডে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে ভাড়া বাসায় সংসার শুরু করেন। এই দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট নাদিম হাওলাদার। ১৮ বছর বয়সের নাদিম ১৫ বছর আগে বাবাকে হারায়। অভাব অনটনের সংসারে লেখাপড়ায় প্রাইমারির গন্ডি পেরুতে পারেনি। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার শুরু করলে মা-বোনের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে এই নাদিমের ঘাড়েই। অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে আহত হয়। বর্তমানে চিকিৎসা চলছে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে জরুরি বিভাগের তৃতীয় তলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের বিশেষায়িত বি ওয়ার্ডের (পুরুষ) ৪ নম্বর শয্যায়। নাদিমের মা ফিরোজা বেগম বলেন, 'নাদিমের বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা মারা যায়। ছোট ছেলেকে তিলে তিলে বড় করেছি। এখন গুলি খাওয়া ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছি। চিকিৎসকরা প্রথমে বলেছিল, ছেলের হাত কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু আমি হাত কাটতে দেইনি। হাত কাটলে ছেলে কি করে কাজকর্ম করবে। কীভাবে খেয়ে-পরে বাঁচবে। এখন ছেলের চিকিৎসা চলছে। হাতের কৃত্রিম রগ লাগানো হয়েছে। ভাঙা হাতের চিকিৎসা চলছে।' বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত নাদিম হাওলাদার সে দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, 'দেশে কারফিউ চলছিল। কোনো কাজ ছিল না। অটো নিয়ে বের হয়নি। ১৭ জুলাই থেকে আন্দোলনে যোগ দেই। এলাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই ছিলাম। ২০ জুলাই বিকাল থেকে আমাদের এই রোডে বিমানের জ্বালানি বহন করা ১০০ তেলবাহী গাড়ি তেল নিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় পুলিশ, আনসার, সেনা ও বিজিবি এই তেলবাহী এই গাড়িগুলো নিরাপদে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। শিক্ষার্থীরা সেটা আটকে দিলে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় অনেকে আহত ও নিহত হয়েছে।' আহত নাদিম হাওলাদার বলেন, '২০ জুলাই সন্ধ্যা ৭টার পর সংঘর্ষের সময় আমার বাম হাতে কুনুইয়ের নিচে একটা ওপরে দুইটা এবং বুকের পাশে বগল বরাবর একটাসহ মোট ৪টা গুলি লাগে। কুনুইয়ের নিচে গুলিটা কয়েকটা রগ নিয়ে মাংসসহ আলাদা হয়ে পড়ে যায়। কুনুইয়ের উপরের গুলিটা হাড় ভেঙে বের হয়ে যায়। বগলের পাশে যে গুলিটা লেগেছে, সেটা বের হয়ে যায়। এ সময় আমার জ্ঞান ছিল না।' বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত নাদিম হাওলাদাকে প্রথমে সাইন বোর্ডের একটি স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফার্ড করা হয়। সেখানে রাখা হয়নি। সেখান থেকে হৃদরোগ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। নাদিম হাওলাদার বলেন, 'হাতের রগসহ মাংসপিন্ড ক্ষতি হয়েছে বলে ঢাকা মেডিকেল থেকে হৃদরোগ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখান থেকে বলা হলো আমার আগে ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা করার জন্য, না হলে রগের চিকিৎসা করা যাবে না। এভাবে কয়েকটা হাসপাতালে ঘুরাঘুরি করার পর আমার চিকিৎসা শুরু হলো হৃদরোগ হাসপাতালে। হাতের রগ লাগানোর পর ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গিয়ে ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা শুরু হয়।' এক সময় হাসাপাতালে আলোচনা শুরু হয়, যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হবে। সেই ভয়ে নাদিমের আত্মীয়স্বজন তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়। এ ছাড়া হাতের সব টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতাল ছাড়ার অন্যতম কারণ মনে করেন তারা। নাদিম আরও বলেন, সর্বশেষ গত মাসের ২২ তারিখে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন হাড় ভাঙার চিকিৎসা চলছে। বুকের ক্ষত এখনো ভালো হয়নি। হাতে রগ লাগালোর পর হাতে কিছু ধরার শক্তিও পাইনি। আদো কি আমি এই হাতে কিছু করতে পারব, তা বিশ্বাস হচ্ছে না।' নাদিম হাওলাদারের মা বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম বলেন, 'এই হাসপাতালে চিকিৎসা বিনামূল্যে পাচ্ছি। তবু ছেলের চিকিৎসায় এ পর্যন্ত দেড় লাখের ওপর টাকা খরচ হয়েছে। এখনো প্রতিদিন টাকা লাগছে। হাসপাতালে থেকে কবে ছাড়া পাব, তাও বলা যাচ্ছে না। এখন আর পারছি না। অনেকে অনেক জায়গা থেকে টাকা পেয়েছে। আমরা কোথাও থেকে টাকা পাইনি। মানুষ ১০০, ৫০০ করে টাকা দিয়েছিল, সেটা ১০ হাজারের বেশি হবে না। শুরু থেকে আমি ছেলের সঙ্গে আছি। আগে ছাত্ররা ভাত-খাবার দিত। এখন তারা কোনো কোনো খাবার দেয় না। হাসপাতালের খাবারে এখন আর চলে না। আমাদের প্রতিদিন বাইরে থেকে ৩০০-৩৫০ টাকার মতো খাবার কিনতে হয়।'