ব্যর্থ সেই কৌশলে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রির উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ফের বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ৭টি প্রতিষ্ঠান সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পেয়েছে। সাময়িক সময়ের জন্য ডিম আমদানি শুল্কমুক্ত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কাঁচামরিচের লাগামহীন দর নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্প্রতি ভারত থেকে এ পণ্যের আমদানি বাড়ানো হয়েছে। গত সোমবার হিলি স্থলবন্দরে ভারত থেকে একদিনে ৩৫০ মেট্রিক টন কাঁচামরিচ আমদানি করা হয়েছে। যা সম্প্রতি সময়ে রেকর্ড পরিমাণ কাঁচা মরিচের আমদানি। আর এ পণ্যটির আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে চড়তে থাকা দাম এরইমধ্যে বেশখানিকটা কমেছে। অন্যদিকে চিনির বাজারদর সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখতে ৯ অক্টোবর অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান রেগুলেটরি ডিউটি ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির ওপর শুল্ক কর ১১.১৮ টাকা এবং পরিশোধিত চিনির ওপর শুল্ক কর ১৪.২৬ টাকা কমবে। কেবল ডিম, কাঁচামরিচ কিংবা চিনিই নয়; দেশে সম্প্রতি আলু ও পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দাম নিয়ন্ত্রণে গত ৫ সেপ্টেম্বর এ পণ্য দুটির আমদানি শুল্কহ্রাস করা হয়েছে। আলুর ক্ষেত্রে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আলু আমদানিতে যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে পেঁয়াজের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে নেয় অন্তর্র্বর্তী সরকার। অথচ বাজারে এর আশানুরূপ প্রভাব পড়েনি। বিগত সময়ও আমদানি ও শুল্ক হ্রাসের কৌশল বারবার ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা ও বাড়ানো এবং শুল্ক হ্রাস একটি 'সাময়িক' পদক্ষেপ। এর ফলে অবৈধ মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী বাজার সিন্ডিকেটকে শায়েস্তা করা যায়। তবে অর্থনীতিবিদ ও বাজার পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দাম কমাতে তাৎক্ষণিক \হব্যবস্থা হিসেবে আমদানি না করে, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রম্নটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা এবং আমদানি নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। বিগত সরকারের আমলে বাজার সিন্ডিকেটের অপতৎরতা রুখতে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। শুল্কহ্রাস ও তা পুরোপুরি তুলে দেওয়ারও যথেষ্ট নজির রয়েছে। অথচ এ কৌশলে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে একই ফর্মুলায় এখনও বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হলে তা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তারা। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে আমদানিই যেন বাজারের আগুন নেভানোর একমাত্র সমাধান। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনাগত ত্রম্নটির কারণে ডিমের দাম বেড়েছে। এ রকম ক্ষেত্রে আমদানি করে সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা কঠিন। কারণ বাজারে সরবরাহের ঘাটতির কারণে পণ্য আমদানি করা হলে সেটি বাজারে তেমন প্রভাব ফেলে না। বরং কৃত্রিমভাবে বাজারে পণ্যের যোগান নিয়ন্ত্রণ করতে আমদানি করার পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক হয় না এবং দামও কমে না। এই গবেষক মনে করেন, আমদানি যথেষ্ট পরিমাণে হলে বড় ব্যবসায়ীরা তাদের হাতে থাকা পণ্য বাজারে ছেড়ে দিতে পারেন, ফলে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের দাম কমলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যে কোন দেশের অর্থনীতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে বড় দুঃশ্চিন্তার বিষয়। এর অর্থ হলো, প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের জন্য তখন অন্যের ওপর নির্ভর করতে এবং তার পেছনে দেশের আয়ের বড় অংশটি ব্যয় করতে হবে। এর ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ারও সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই কিছু বড় ব্যবসায়ী পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে থাকেন। পণ্য আমদানি করা হলে তখন তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অনেকে হয়তো ব্যবসা ছেড়ে দিতেও বাধ্য হতে পারেন। তখন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর হাতেই থাকবে ডিমের বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এ রকম পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে বাজারে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ তখন প্রতিযোগিতামূলক বাজার না হয়ে অলিগোপলিস্টিক মানে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যখন পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তেমন একটি বাজারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এর ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। খামারিরা জানান, আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে ডিম আনার কারণে দেশের উৎপাদন মূল্য ও বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে ডিম আনতে পারবেন এবং ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবেন। এমন ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ডিম উৎপাদকদের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা থেকে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ডিমের দামও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, শুল্কহ্রাস ও আমদানির ফর্মুলায় বিগত সময়ও বাজার সিন্ডিকেটকে ঘায়েল করা যায়নি। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সেই পুরানো কৌশলই নিয়েছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, উৎপাদন বাড়ানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা। সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও মূলত সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই ডিমের দাম এতটা বেড়েছে বলে দাবি করেন তারা। এদিকে তাদের এ অভিযোগ যে অমূলক নয়, তা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক অভিযানেই অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় তাদের এক বিশেষ অভিযানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দেখা গেছে, 'রাশেদ সিন্ডিকেট' ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্ম থেকে ১১ টাকা ১ পয়সায় পাইকারিতে ডিম কিনে খুচরায় ১৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। অর্থাৎ একটি ডিমেই ৩ টাকা ৯৯ পয়সা লাভ করছে। এ হিসাবে এক ডজন ডিমে তারা ৪৭ টাকা ৮৮ পয়সা লাভ করছে। বাজার পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ডিমের বাজারের এ খেলোয়াড়দের না ধরে ডিম হ্রাসকৃত শুল্কে ডিম আমদানির অনুমোদন বাস্তবে কতটা কাজে আসবে তা সহজেই অনুমেয়। বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিশ্চয়ই অজানা নয়। অথচ বরাবরের মতো তারা সেই একই পথেই হাঁটছে। যা উদ্দেশ্যমূলক বলেই মনে হচ্ছে। এদিকে ডিম ছাড়াও কাঁচা মরিচ, আলু, পেঁয়াজ ও চিনির দাম বাড়ার ঘটনায় বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার দিকে নজর না দিয়ে পণ্য আমদানি করা বা আমদানি শুল্ক কমানোর মত যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে বাজার সিন্ডিকেট আদৌও ভাঙা যাবে কিনা তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা। অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রায় সব জায়গাতেই আমাদের মনে হচ্ছে যে প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাঠামো হলে যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত, নজরদারি বা ব্যবস্থা নেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সেই ক্ষেত্রগুলোতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এদিকে চিনির বাজার দর সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখতে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান রেগুলেটরি ডিউটি ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও এতে বাজারে আশানুরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন না বাজার পর্যবেক্ষকরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর নভেম্বরে আমদানি শুল্ক অর্ধেক কমানোর পর এক টাকাও কমেনি চিনির দাম বরং বেড়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, চিনি আমদানিতে মনোপলি সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম কমানো কঠিন। অথচ সে দিকে গুরুত্ব না দিয়ে সেই পুরানো কৌশলে আবারও আমদানি শুল্কহ্রাস করে অন্তর্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যা দিন শেষ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন সময় সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করে দিলেও আমদানিকারক, আড়তদাররা তা তোয়াক্কা করেন না। তারা ইচ্ছামতো চিনির দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেন। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক কয়েকটি সিন্ডিকেট চিনির বাজার জিম্মি করে রেখেছে। সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। চিনির দাম বাড়ার অন্যতম কারণ 'স্স্নিপ বাণিজ্য' বলে ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, খাতুনগঞ্জের বাজারে পণ্য বেচাকেনা ও লেনদেনে যুগ যুগ ধরে কিছু প্রথা চালু আছে। যেগুলো আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) স্স্নিপ। চিনি কিংবা অন্য কোনো পণ্য কেনাবেচায় ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে বিভিন্ন আগাম লেনদেন হচ্ছে। দেখা যায়, পণ্য হাতে না পেলেও ওই স্স্নিপটিই বেচাকেনা হচ্ছে। কোনো কোম্পানি বাজার থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের ডিও কিনে নেয়। যে দরে ডিও কেনা হয়, তার বাজার দর যদি বেড়ে যায়, তখন পণ্য ডেলিভারি দিতে তারা গড়িমসি করে। আবার দেখা যায়, কোম্পানির পণ্যই আসেনি; কিন্তু ডিও কিনে রেখেছেন অনেক বেশি। এর ফলেও কোম্পানি বাজারে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না। ফলে এসব পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এক্ষেত্রে চিনির ডিও বেচাকেনা বেশি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, কিছু বড় বড় গ্রম্নপ চিনির বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। প্রশাসন শক্ত হাতে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে চিনির বাজারের অস্থিরতা কাটবে না। চিনির পুরো বাজারও এখন সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এমন ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা গেলে তবেই ভোক্তারা সুবিধা পাবেন।