বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১
তিন জেলায় ৮ মৃতু্য

ময়মনসিংহ-নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

কংস নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে দুই জেলায় নতুন করে পস্নাবিত ৪০ গ্রাম পানিবন্দি আড়াই লক্ষাধিক মানুষ
যাযাদি ডেস্ক
  ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বিলডোরা ইউনিয়নে দারিয়াকান্দা গ্রামে পানিতে পস্নাবিত বসতবাড়ি। ছবিটি মঙ্গলবার তোলা -সংগৃহীত

মঙ্গলবার ভোর থেকে সকাল ৮ পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে নতুন করে দুই জেলার আট উপজেলার অন্তত ৪০ গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছেন আড়াই লক্ষাধিক মানুষ। নেত্রকোনার পূর্বধলার জারিয়া এলাকা কংস নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধের দুই স্থান। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানি ও খাদ্যের সংকট। তবে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।

এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে বন্যাসম্পর্কিত নিয়মিত প্রতিবেদনে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলেছে, তিন জেলার সাড়ে ৬৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বন্যায় এ পর্যন্ত আটজনের মৃতু্য হয়েছে, যাদের সবাই শেরপুর জেলার।

ময়মনসিংহ জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন মঙ্গলবার জানান, সকালের টানা বৃষ্টিতে কংস ও নেতাই নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কংস নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ধোবাউড়া উপজেলার আইলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেশ কয়েকটি ঘরে পানি ওঠায় দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা।

তিনি জানান, তিন উপজেলায় ৭ লাখ টাকা ও ৬৩ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। বৃষ্টি না হলে পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে। হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া

এবং ফুলপুর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় নারী ও শিশুসহ কয়েক শতাধিক মানুষ উঠেছে; সেখানে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আশ্রয়ণের বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, 'আশ্রয়ণ প্রকল্পে গত এক সপ্তাহ ধরে ঘরের চারপাশে পানি। পোলাপান নিয়ে পানির মধ্যে খুব কষ্টে আছি। সোমবার শুধু একটি সংগঠন আমাদের খাবার দিয়েছে। কিন্তু প্রশাসন থেকে এখনো কেউ খোঁজ-খবর নেয়নি।

আরেক বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন বলেন, 'মঙ্গলবার সকালে পানি বাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েকটি ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। নদীর পাশে বসবাস করায় তাদের সবসময় আতঙ্কে কাটাতে হচ্ছে। কখন পানি বেড়ে ঘর ডুবে যায়।'

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মিনতি রানী পাল বলেন, 'বন্যায় পূজার আনন্দ ম্স্নান হয়েছে। দুবেলা খাবারই কপালে জুটছে না। তাহলে পূজা কীভাবে করব। সরকার সহযোগিতা করলে অন্তত সন্তানদের নিয়ে চলতে পারতাম।'

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন বলেন, 'বন্যার পঞ্চম দিনে সকালে বৃষ্টি হওয়ায় পানি কিছুটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে নতুন কয়েকটি এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। বানভাসিদের শুকনো খাবারের পাশাপাশি ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।'

ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম আরিফুল ইসলাম বলেন, 'সকালের কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে নতুন করে উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নসহ চারটি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়েছে। এতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে আরও ১৬টি গ্রাম। বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।'

হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদুল আহমেদ বলেন, 'উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানাবর্ষণে হালুয়াঘাটে বন্যার সৃষ্টি হয়। উজানের পানি কমে এখন নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮ হাজার পরিবার। সাময়িকভাবে বন্যার্তদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি ক্ষতি নিরূপণ করে সামগ্রিক সহযোগিতা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হবে।'

এদিকে, মঙ্গলবার ভোর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় নেত্রকোনায় বেড়েছে বন্যার পানি। এতে পস্নাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নেত্রকোনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পূর্বধলার জারিয়া বাজার এলাকায় মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক সাওয়ার জাহান জানান, উব্দাখালীর পানি কলমাকান্দা ডাকবাংলো পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৬ দশমিক ৫৫ মিটার। অবশ্য দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী ও সদর উপজেলার কংস নদের পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে পানি কিছুটা বাড়লেও আশা করা যাচ্ছে দ্রম্নত নেমে যাবে।'

ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নেত্রকোনার ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া শেরপুরের ভোগাই-কংসের পানি জারিয়া এলাকায় কংস নদ দিয়ে কলমাকান্দায় উব্দাখালী নদীতে প্রবাহিত হয়। এতে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর- পাঁচটি উপজেলায় বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর উপজেলার ১৩১টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এর মধ্যে গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটে পানি উঠেছে।

জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, 'কিছুটা দম ধরে মঙ্গলবার সকাল থেকে পানি বাড়ছে। পূর্বধলার জারিয়া এলাকা কংস নদের তীরে থাকা বেড়িবাঁধটি দুই স্থানে ভেঙে গেছে। এরপর থেকে পূর্বধলা, সদর ও বারহাট্টার বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফসলিজমিরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। তবে বন্যা মোকাবিলায় আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'

বনানী বিশ্বাস জানান, এ পর্যন্ত ৩ লাখ টাকা, ২ হাজার ৮০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও ৭০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র ও জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ২৭টি ইউনিয়নে ১৩১টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন ৬৫ হাজার মানুষ। ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে ৪৩টি পরিবার। প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়। পাঠদান বন্ধ রাখা হয় ২০৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৮৬টি। ২১৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। প্রায় ৩১০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে রয়েছে।

কলমাকান্দার ঘনিচা গ্রামের ফরিদ তালুকদার বলেন, 'পানি সকাল থেকে আরও বাড়ছে। ১৫ একর জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলাম। বেশকিছু ক্ষেতের ধান গাছে শিষ ছাড়ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে সব ধানগাছের ওপর তিন থেকে আট ফুট পানি। তিনদিন ধরে এ অবস্থা। মনে হয় কোনো ধানগাছ আর টিকবে না।'

দুর্গাপুরের কাকৈইগড়া ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের কৃষক রহমত আলী বলেন, 'চার দিন ধরে গ্রামের সবার ধানক্ষেত পানির নিচে। কোনো ক্ষেতের ধানই আর রক্ষা হবে না। গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে আছি। উঁচু সড়কে খোলা আকাশের নিচে গরু রাখা হয়েছে। খড় না থাকায় খাবার দিতে পারছি না। এলাকার সবারই একই অবস্থা।'

তিন জেলায় ৮ মৃতু্য

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানিয়েছে, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে নদ-নদীর পানি বেড়ে ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনায় সৃষ্ট বন্যায় এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩২ হাজার ২৯০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলাগুলোতে ১২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে ১ হাজার ৫১৭ জন মানুষ ও ৯৪৮টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে।

মন্ত্রণালয় বলছে, বন্যায় শেরপুরের ৫ উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের ৫৯ হাজার ৯০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখনো পানিবন্দি ১৩ হাজার ৮০টি পরিবার। নালিতাবাড়ী উপজেলার ছয়জন আর নকলা উপজেলার দুইজন মারা গেছেন।

তারা হলেন- ইদ্রিস আলী (৬৫), জহুরা (৭০), আমিজা খাতুন (৪৫), মো. হাতেম আলী (৩০), আলমগীর হোসেন (১৬), জিমি (৮), আব্দুর রাজ্জাক (৫২) ও রাহিম (৫)।

শেরপুরের ৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০৬ জন মানুষ ও ৭৩৭টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার্তদের সহায়তায় জেলায় ১৪টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টি টিম কাজ করছে।

বন্যাকবলিত ময়মনসিংহের তিন উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের মোট ১ লাখ ৪৯ হাজার ২০০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় ৩২ হাজার ৪৪০টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

এ জেলায় মোট ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১ হাজার ১০৬ জন মানুষ এবং ২১১টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি বন্যার্তদের সহায়তায় ২৩টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে; যেখানে ছয়টি টিম কাজ করছে।

অপরদিকে বন্যাক্রান্ত নেত্রকোনার পাঁচ উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের ২৪ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে ২২ হাজার পরিবার।

এ জেলার সাতটি আশ্রয়কেন্দ্রে ১০৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার্তদের সহায়তায় জেলায় কাজ করছে পাঁচটি মেডিকেল টিম।

মঙ্গলবার বিকালের তথ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, এ বিভাগের নীল জিঞ্জিরাম নদীর গোয়ালকান্দা পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার কমলেও এখনো বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর নেত্রকোনা জেলার সোমেশ্বরী নদীর কলমাকান্দা পয়েন্টে পানি ৫ সেন্টিমিটার কমলেও এখনো ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। তবে ময়মনসিংহ বিভাগের জিঞ্জিরাম নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। অপরদিকে, ভুগাই-কংস ও সোমেশ্বরী নদীর পানি কমছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাতে বন্যা তথ্যে বলা হয়েছে, আগামী তিন দিন ময়মনসিংহ বিভাগ ও এর উজানে অতিভারি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কম। এর পরিপ্রেক্ষিতে, আগামী তিন দিন পর্যন্ত ভুগাই-কংস নদীর পানি কমতে পারে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে