সুন্দরবনে জরিপের ফল
১১টি বেড়ে সুন্দরবনে বাঘ এখন ১২৫টি
আগের দুটি জরিপে (২০১৮ ও ২০১৫) অপরিণত বা শিশু বাঘের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৫টি। এবার তা ২১টি পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে বাঘ আরও বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে
প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
গত ছয় বছরে দেশে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে ১১টি। বাঘের একমাত্র আশ্রয়স্থল সুন্দরবনে জরিপ চালিয়ে এই সংখ্যা পেয়েছে বন বিভাগ। এর মধ্যে খুলনায় বাঘের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তবে সাতক্ষীরায় তা কমেছে। চোরা শিকারিদের প্রভাব ও বাঘের খাবার (হরিণ) কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের ওই এলাকায় বাঘের সংখ্যা কমেছে বলে মনে করছে জরিপকারী দলটি।
মঙ্গলবার বন বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঘের সংখ্যা এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। গত বছরের জানুয়ারি, এপ্রিল, নভেম্বর এবং ২০২৪ সালের মার্চে সুন্দরবনে ওই জরিপ করা হয়। বনের ২ হাজার ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ওই জরিপ চালানো হয়। সেখানে স্থাপন করা হয় মোট ৬৫৭টি ক্যামেরা ফাঁদ। বাঘ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই ক্যামেরায় ছবি ওঠে। ক্যামেরায় ওঠা মোট ৩১ হাজার ৪৮২টি ছবির মধ্যে বাঘের ছবি ছিল ৭ হাজার ২৯৭টি।
ক্যামেরা ছাড়াও সুন্দরবনের ১ হাজার ৩০৬ কিলোমিটার খালপাড়ে সরেজমিন জরিপ করা হয়। এসব খালে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা ও ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। জরিপে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২ দশমিক ৬২টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ক্যামেরায় মোট ৮৪টি বাঘের ছবি পাওয়া গেছে। বাকি ৪১টি বাঘ খাল জরিপের মাধ্যমে পাওয়া গেছে।
বাঘ জরিপের ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন
চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। ওই সংখ্যা আরও বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি। সবার সহযোগিতার মাধ্যমে তা সম্ভব বলে মনে করি।'
এবারের জরিপে সুন্দরবনের খুলনা অংশে বাঘের নারী-পুরুষের সংখ্যার ক্ষেত্রে বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা দেখা গেছে। ক্যামেরা জরিপে দেখতে পাওয়া ৮৪টি বাঘের মধ্যে ২১টি নারী ও ৬২টি পুরুষ বাঘ। আর একটি বাঘ নারী না পুরুষ তা নির্ধারণ করা যায়নি। সামগ্রিকভাবে বাঘের নারী ও পুরুষের ওই সংখ্যার ভারসাম্য ঠিক আছে বলে মনে করছেন বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
তবে জরিপে খুলনা রেঞ্জে বাঘের নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বেশ ভারসাম্যহীনতা দেখা গেছে। ওই এলাকায় একটি পুরুষ বাঘের বিপরীতে ১২টি নারী বাঘ দেখা গেছে। অর্থাৎ ওই এলাকায় একটি বাঘ মারা গেলে পুরো এলাকা পুরুষ বাঘশূন্য হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে বাঘের সংখ্যা দ্রম্নত কমে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ওই এলাকায় পুরুষ বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে প্রতিবেদনে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে চোরা শিকারিদের ভূমিকার কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে ওই শিকারিদের বড় অংশ বাঘের বাচ্চা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করে বলে অন্যান্য গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। ভারত ও তিব্বত হয়ে এসব বাঘ চীন, থাইল্যান্ডসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাচার হয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে ওই জরিপে দেশের বাঘের সংখ্যা নিয়ে আরেকটি ইতিবাচক দিক ফুটে উঠেছে। এর আগের দুটি জরিপে (২০১৮ ও ২০১৫) অপরিণত বা শিশু বাঘের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৫টি। এবার তা ২১টি পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে বাঘ আরও বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বন বিভাগের ভাষ্য, বাঘ জরিপের জন্য সুন্দরবনে গাছের সঙ্গে মাটি থেকে ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ক্যামেরার সামনে দিয়ে কোনো বাঘ বা অন্য যেকোনো প্রাণী গেলে ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটির ছবি ও ১০ সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করে রাখে। এরপর ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে পাওয়া ছবি বন অধিদপ্তরের রিসোর্স ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইউনিটে বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের খালে সাধারণত সব বাঘ পানি খেতে আসে। এতে খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ পড়ে। বাঘের ধরন অনুযায়ী ওই ছাপ ভিন্ন হয়। এভাবে পায়ের ছাপ দেখেও বাঘের সংখ্যা গোনা যায়।
বিশাল সুন্দরবনে ডোরাকাটা একই রঙের, একই রকম দেখতে বাঘগুলো কীভাবে আলাদাভাবে শনাক্ত করা হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, একজন মানুষের আঙুলের ছাপের সঙ্গে আরেকজনের ছাপের যেমন মিল নেই, তেমনি একটি বাঘের ডোরাকাটার সঙ্গে আরেকটি বাঘেরও মিল থাকে না। ক্যামেরায় একেকটি বাঘের শতাধিক ছবিও ওঠে। সেসব ছবি সংগ্রহের পর কম্পিউটারের সফটওয়্যারে প্রতিটি বাঘের আলাদা করে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই জানা যায়, সুন্দরবনে ঠিক কতগুলো বাঘ আছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এর আগে ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উলেস্নখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই দুটি জরিপে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। ২০১৫ সালের জরিপ ছিল সর্বাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। ওই জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬টি। এই সংখ্যাটিকেই নির্ভরযোগ্য ধরে পরে বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪টিতে।