কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ পাচ্ছে জাপান। যৌথ অংশীদার হতে না পারলেও মাতারবাড়ী বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ভারত ও চীন। এ দুই দেশের প্রতিযোগিতার কারণে দীর্ঘদিন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ আটকে থাকলেও শেষ পর্যন্ত জাপানের অর্থায়নই হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকার এ বন্দর। আর প্রতিযোগী দুই দেশকে হাতে রেখে তৃতীয় একটি দেশকে দিয়ে বন্দর নির্মাণের কৌশলকে কূটনৈতিক বিজয় হিসেবেই দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে বিকেল ৩টায় শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
এদিকে, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর এবং ব্যয় ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা বাড়িয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৩৭ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া এই গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের
খরচ সামান্য বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধিত প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়াল ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।
এক-তৃতীয়াংশের বেশি ব্যয় বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা না করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্যয় বৃদ্ধির কারণ 'টেকনিক্যাল' এবং তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি 'অবগত' নন।
তিনি জানান, অতিরিক্ত এই অর্থ জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ হিসেবে দেবে সরকারকে।
সভায় দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।
সভার পর ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, অন্তর্র্বর্তী সরকারে এটিই একমাত্র 'বড় অবকাঠামো প্রকল্প' হতে পারে।
তিনি বলেন, 'মাতারবাড়ীতে যেহেতু একটা জেটি হয়েই গেছে, আবার একটা গভীর সমুদ্রবন্দর করার প্রকল্প, আমরা বিবেচনা করেছি। এটা একটা বড় প্রকল্প। কিন্তু এই প্রকল্পের অনেক ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য আছে এবং কারা করছে এটাও একটা বড় বিষয়।'
প্রকল্পটির গুরুত্ব তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, 'প্রথমত আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর লাগবেই এটা আমরা সবাই জানি। চট্টগ্রামের সেই সক্ষমতা নাই, পায়রা বন্দরের তো একদমই না। বাংলাদেশের যখন আরও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, একটা গভীর সমুদ্র বন্দর না হলে ব্যবসা খরচ অনেক বেড়ে যায়।'
'এটা আমরা সাহস করে করলাম এই কারণে যে, অনেকদিন ধরে চীন করবে না ভারত করবে, এ নিয়ে বহু টানাপড়েন চলছিল, কোনোকিছুই হচ্ছিল না।'
জাপানের অর্থায়ন নিয়ে বলেন, 'আমরা ভাবলাম যে, জাপান কিন্তু একটা দেশ যেটা অত্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ দেয়। জাপানি প্রকল্পগুলো একমাত্র প্রকল্প সম্ভবত যেগুলো কিছুটা দক্ষিণ কোরিয়াও ঠিক খরচের মধ্যে ঠিক সময়ের মধ্যে শেষ হয়। যেমন, মেট্রোরেলের ৫ লাইনটা, ঢাকা তৃতীয় বিমানবন্দর।'
ব্যয় বাড়ল দ্বিতীয় প্রকল্পেরও
অন্তর্র্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় একনেক বৈঠকে মোট চারটি প্রকল্প তোলা হয়। এর মধ্যে দুটি সংশোধিত এবং দুটি নতুন প্রকল্প।
সংশোধিত দ্বিতীয় প্রকল্পটি হলো সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন বা সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ এর অধীনে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ।
এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩৭৬ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকায় প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। পরে দুই দফায় ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১৮ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা।
অন্তর্র্বর্তী সরকার নতুন করে বাড়ানোর পর নতুন ব্যয় দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
আরও সাতটি প্রকল্পের ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'চলতি প্রকল্পগুলো সংশোধন করা হচ্ছে। তাই সময় লাগছে।'
'বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কম হয়, প্রকল্প ধীরগতিতে এগোলে অর্থ প্রবাহ বাড়বে না। অর্থ প্রবাহ বাড়াতে আগের প্রকল্পের কাজ এগোতে হবে, নতুন কিছু প্রকল্প হাতে নিতে হবে।'
সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকায় কালুরঘাট সেতু
নতুন প্রকল্প হিসেবে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর একটি 'রেল কাম রোড' সেতু নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে; যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
ঢাকার বাইরে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নাগরিক সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে 'রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণ করা ও যানজট নিরসনে' রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টও অনুমোদন হয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯০১ কোটি টাকা।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে একটা নীতিমালা করে দেওয়া হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, 'যেন কোনো সরকার ইচ্ছামতো পরিবর্তন করতে না পারে।'
সরকারি গাড়ির হিসাব চাইলেন
প্রকল্প গ্রহণের সময় অসংখ্য গাড়ি চাওয়া হলেও পরে সেগুলো কোথায় ব্যবহার হয়, কী হয়, তার সঠিক তথ্য কেউ জানে না বলেও মন্তব্য করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেন, 'সারাদেশে কতগুলো গাড়ি আছে তার একটা হিসাব করব।'
'আমরা দেখেছি এক কর্মকর্তা তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। নিজের গাড়ি টেকে বেশি দিন, কিন্তু সরকারি গাড়ি দ্রম্নত নষ্ট ও অপচয় হয়।'
খুব শিগগির তথ্য জোগাড় করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'কত গাড়ি কীভাবে ব্যবহার হয়, কারা ব্যবহার করে সব হিসাব হবে। কোনো সরকারি গাড়ি নষ্ট হলে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হবে।'