শ্রমিক অসন্তোষ :গাজীপুর ও ধামরাইয়ে বিক্ষোভ নারায়ণগঞ্জে অনশন
প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
বেতন ও হাজিরা বোনাস বাড়ানো এবং বকেয়া বেতন পরিশোধসহ নানা দাবিতে গাজীপুর ও সাভার শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা সোমবার সকালে ফের মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এদিকে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে একই দিনে নারায়ণগঞ্জ বিকেএমইএ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পৃথক এই বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে ধামরাইয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জগামী লেনে ও গাজীপুর মহানগরীর জিরানী এলাকায় চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কের উভয় দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন পরিবহণ যাত্রী ও চালকরা। পরে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে গিয়ে কারখানার সামনে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। শিল্প-পুলিশ জানিয়েছে, শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে যান। পরে ধীরে ধীরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
জানা গেছে, ঢাকার ধামরাইয়ে বেতন বৃদ্ধি, সাপ্তাহিক ছুটিসহ ৯ দফা দাবিতে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের শ্রমিকেরা সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে উপজেলার গাংগুটিয়া ইউনিয়নের বারবাড়িয়া এলাকায় কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এর আগে সকাল ৬টা থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জগামী লেনে অবস্থান নেন শ্রমিকরা। এতে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে সড়ক
থেকে তারা সরে যান।
শ্রমিকদের ৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা করা, বেতনের অর্ধেক ঈদ বোনাস দেওয়া, প্রতিদিন সবাইকে ডিউটি দেওয়া, কর্মদক্ষতার ওপর ভিত্তি করে চাকরি স্থায়ীকরণ করা, কোম্পানির লভ্যাংশ দেওয়া, নাইট বিল দেওয়া, কোম্পানির ভেতরে কোনো শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায়ভার কোম্পানিকে নেওয়া, কোম্পানির প্রতিটি বিভাগে নিরাপত্তাব্যবস্থা করা ও সাপ্তাহিক ছুটি।
শ্রমিকেরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকেরা প্রতিষ্ঠানের কাছে নানা দাবি-দাওয়া জানিয়ে আসছিলেন। প্রতিষ্ঠান মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করলেও দাবি মেনে নেয়নি। তিন মাস আগে বেতন বৃদ্ধির কথা বলা হলেও এখনো শ্রমিকেরা বর্ধিত বেতন পাননি। এরই জেরে ৯ দফা দাবিতে তারা বিক্ষোভ করছেন।
আনোয়ারা নামে একজন শ্রমিক বলেন, 'সাত হাজার টাকা বেতন পাই। তাতে কিছু হয় না। পরিবার নিয়ে চলতে পারি না। বারবার বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছি। কিন্তু দাবি মানেনি। নিয়মিত ডিউটি দেয় না। কোনো ছুটি নেই। পাঁচ বছর ধরে চাকরি করি। কিন্তু স্থায়ী করেনি। তাই আন্দোলন করছি।'
এদিকে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানার সামনে হাইওয়ে পুলিশ, এপিবিএন, শিল্প-পুলিশ, আনসার ও সেনা সদস্যরা অবস্থান নেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যস্থতায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষ দফায় দফায় বৈঠক করে।
এ বিষয়ে শিল্প-পুলিশ-১-এর উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম বলেন, 'শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবি করেছেন। তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক রয়েছে।'
নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের অনশন
আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে নেমকন ডিজাইন লিমিটেড, ক্রোনী গ্রম্নপসহ সব পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও ত্রিপক্ষীয় ১৮ দফা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অনশন করেছেন শ্রমিকেরা। সোমবার বেলা ১১টার থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকায় বিকেএমইএর প্রধান কার্যালয়ের সামনে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
বেলা ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের পাঠানটুলি এলাকায় নেমকন ডিজাইন লিমিটেড এবং ফতুলস্নার শাসনগাওয়ের ক্রোনী গ্রম্নপের অবন্তী কালার টেক্স ও ক্রোনী অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকেরা বকেয়া বেতনের পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে নগরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা নগরের চাষাঢ়ায় বিকেএমইএর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে অনশন কর্মসূচি পালন করেন।
বিক্ষোভ ও অনশন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। বেলা আড়াইটার দিকে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ১০ অক্টোবরের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিলে শ্রমিকেরা অনশন ভাঙেন।
শ্রমিকদের অভিযোগ, গত তিন মাস শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করছে না। শ্রমিক ছাঁটাই ও সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রমিক নির্যাতন করে আসছে। মালিকপক্ষ নানা অজুহাতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে টালবাহানা করছে। ক্রোনী গ্রম্নপের অবন্তী কালার টেক্স ও ক্রোনী অ্যাপারেলস বকেয়া বেতন পরিশোধ ছাড়াই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।
শ্রমিক নেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, 'নারায়ণগঞ্জে ৬টি পোশাক কারখানার ১০ হাজারের মতো শ্রমিকের বেতন বকেয়া রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের বেতন বকেয়া আছে ৫ থেকে ৭ মাসের। বেতন পরিশোধ এবং উপদেষ্টাদের উপস্থিতিতে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় ১৮ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে বিকেএমইএর প্রধান কার্যালয়ের সামনে শ্রমিকেরা অনশন করেছেন। মজুরি না পেয়ে শ্রমিকেরা আর্থিক সংকটে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।'
১০ অক্টোবরের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে কঠোর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেন এই শ্রমিক নেতা।
এ বিষয়ে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'শ্রমিকদের পক্ষ থেকে লিখিত কোনো দাবি আমাদের কাছে আসেনি। মৌখিকভাবে যেটা আমাদের জানানো হয়েছে, সেটার জন্য আমরা কাজ করছি। ১০ অক্টোবরের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে, সেটা আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকসহ আমরা সবাই মিলে সমস্যা সমাধানে কাজ করছি।'
আদমজীতে অবস্থিত শিল্প পুলিশ-৪-এর পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা বলেন, 'নেমকন ও ক্রোনী গ্রম্নপের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। শ্রমিকেরা বকেয়া মজুরি ও ন্যায্য পাওনার দাবিতে বিক্ষোভ ও বিকেএমইএ কার্যালয়ের সামনে অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। পোশাক শ্রমিকদের সমস্যার বিষয়টি আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা চলছে।'
গাজীপুরে মানববন্ধন
গাজীপুর মহানগর প্রতিনিধি জানান, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের শ্রমিকরা ৬ দফা দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। সোমবার বেলা ১১টার দিকে গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন করেন গাজীপুরে কর্মরত শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা জানান, তাদের সরাসরি ইউনিলিভার কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, কোম্পানির নিয়ম কানুন সংস্কার করে বৈষম্যহীন নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে, বেতন বোনাস বৃদ্ধি করতে হবে, চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বিধান নীতিমালা করতে হবে, সাপ্তাহিক ছুটিসহ সব জাতীয় ছুটি দিতে হবে এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড বিপণন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গাজীপুরে কর্মরত জুনিয়র সেলস অফিসার হারুন অর রশিদ বলেন, 'আমরা সারাদেশে ৪৫ হাজার শ্রমিক কাজ করি। ইউনিলিভার দেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হলেও আমরা আমাদের রাজ্যপাল ও শ্রমিক পাচ্ছি না। তাই আমাদের দাবি যদি না মানা হয় তবে আমরা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একযোগে সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করব এবং নিত্যপণ্য সামগ্রী সরবরাহ বিতরণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো।'
এদিকে, হাজিরা বোনাস বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুর মহানগরীর জিরানী এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। এতে চন্দ্রা-নবীনগর সড়কের উভয় দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রী ও চালকরা দুর্ভোগে পড়েন বলে জানান গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবু তালেব।
বিক্ষোভ শুরুর সাড়ে তিন ঘণ্টা পর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে গিয়ে কারখানার সামনে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। এরপর ওই সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
শ্রমিকদের অভিযোগ, সপ্তাহের প্রথম দিকে হাজিরা বোনাস বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে তারা বিক্ষোভ করেন। সে সময় কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ কারণেই তারা টিফিনের সময় সড়কে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন।
কারখানার শ্রমিক আব্দুল মোমিন বলেন, 'এবার যতক্ষণ না মালিক কারখানায় এসে দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। বার বার আশ্বাস দিয়ে তারা কথা রাখছেন না।'
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার দীপক কুমার মজুমদার বলেন, 'বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরানো হয়েছে। এখন তারা কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে।'