টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় দেশের চার জেলা- ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা ও জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। ডুবছে নতুন নতুন এলাকা। ভেসে গেছে মাছের ঘের। ক্ষতি হয়েছে ফসলের। পানিতে ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয়ে দুর্ভোগ আরও বাড়ছে বানভাসিদের। বিশেষ করে শেরপুরের আরও ৫ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে বন্যা। এ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ জনে।
বাসভাসিরা জানান, সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন-যাপন। দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। ইতোমধ্যে অনেকেই অবস্থান করছেন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে।
শেরপুরে পানিবন্দি প্রায় দুই লাখ মানুষ : মহারশি নদীর ভাঙা বাঁধ দিয়ে ৩ দিন ধরে পানি ঢুকছে শেরপুরের লোকালয়ে। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ভাসিয়েছে জনপদ। ডুবেছে পাঁচ উপজেলার অন্তত ২০ ইউনিয়ন। পানিবন্দি প্রায় দুই লাখ মানুষ। খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা।
আমাদের নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি জানান, জেলার নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদী উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে নকলা উপজেলার গণপদ্দি, নকলা, উরফা ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শনিবার থেকে নকলা পৌরশহরে পানি প্রবেশ করা শুরু করেছে। অনেকেই পানিবন্দি আবার অনেকেই ঘরের ধন্যার উপরে অবস্থান করছেন। তলিয়ে গেছে আবাদি কৃষি জমি। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে মৎস্য চাষিদের মাছের ঘের।
ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী জেলাটির চারটি
পাহাড়ি নদীর উজানে পানি কমতে শুরু করলেও ভাটিতে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এ নিয়ে জেলার পাঁচ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়েছে। পানিবন্দি অবস্থায় দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই ভাইসহ ৭ জনের মৃতু্য হয়েছে।
সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে। তবে পানির প্রবল স্রোত আর পর্যাপ্ত নৌযানের অভাবে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলায় বন্যাপরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পানিতে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক এবং বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদী উপজেলার বিরাট এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক জায়গা বসত বাড়িঘর ধসে গেছে এবং শস্য ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ভোগাই নদীর নাকুগাঁও পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার, নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং চেলস্নাখালীর ২৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দুটি পাহাড়ি নদী মহারশি ও সোমেশ্বরীর পানি এখনো বিপৎসীমার সমান রয়েছে। এছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী ও দশানী নদীর পানি।
নকলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, '১৯৮৮ সালের চেয়েও এবার বন্যা ভয়াবহ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও সরকারিভাবে যেসব ত্রাণসামগ্রী আসছে তা বানভাসির তুলনায় খুবই সামান্য। দেশের যারা বিত্তবান আছেন তাদের কাছে আবেদন আপনারা এগিয়ে আসুন বন্যার্তদের পাশে।'
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নকলা অদম্য মেধাবী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক প্রবাসী আবু শরিফ কামরুজ্জামান বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো উদ্ধার কাজসহ শুকনা খাবার দিয়ে বন্যার্তদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। সবারই এগিয়ে আসা উচিত।
মৎস্য চাষি শরিফ হাসান জানান, আমার জীবনে আমি এমন পানি দেখিনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। আমার ১২টি পুকুর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সব মাছ বন্যার পানিতে চলে গেছে। এতে করে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি।
নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দা তামান্না হোরায়রা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়া শুরু করেছি। সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাকিবুজ্জামান খান বলেন, সোমবারের ভেতর কমবে সব নদীর পানি, উন্নতি হবে বন্যা পরিস্থিতির।
ময়মনসিংহে গ্রামের পর গ্রাম পস্নাবিত
এদিকে, ময়মনসিংহে বৃষ্টির সঙ্গে উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় দর্শা ও নেতাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে ডুবছে জেলার নতুন নতুন এলাকা। ১৫টি ইউনিয়নের ৮০টি গ্রাম এরইমধ্যে পস্নাবিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে লাখো মানুষ। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনে। দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার সংকট। বাড়ছে দুর্ভোগ। প্রবল বর্ষণে গাছ উপড়ে পড়ে ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে জেলার ধোবাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন- এবারের বন্যা আটাশির বন্যাকে ছাড়িয়ে গেছে!
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার কলসিন্দুর ঘাটপাড়ে নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। রোববার সকাল থেকে শুরু হয়েছে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম। সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে উপজেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নের।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। শুক্রবার, শনিবার দিনভর বৃষ্টি চলে। টানা বৃষ্টিতে উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া, গামারীতলা, ঘোষগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে ও পাহাড়ি ঢলে গ্রামগুলো ব্যাপকভাবে পস্নাবিত হয়েছে। শনিবার রাতে বৃষ্টিতে ভয়াবহ রূপ নেয়। পুরো উপজেলা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ধোবাউড়া সদর বাজারেও পানি প্রবেশ করে।
স্থানীয়দের দাবি, স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ সালের বন্যাকে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে করা হতো। কিন্তু এবারের পানি সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে। এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি উপজেলাবাসী। ঘরের মধ্যে পানি থাকায় নেই রান্নাবান্না। এতে শুকনা খাবার খেয়ে দিন চলছে। অনেকে খাবারের জন্য হাহাকার করছে। শুক্রবার রাত আটটা থেকেই ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশ করে। অনেকে খাটের ওপর বসে রাত কাটিয়েছে, অনেকে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় রাত কাটিয়েছে।
রোববার ঘোষগাঁও ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও-ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও-বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে গামারীতলা, ঘোষগাঁও এবং দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের লোকজন। নেতাইপাড়ের অসংখ্য লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন মসজিদ ও স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। অন্তত অর্ধশত বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে।
\হধোবাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার বলেন, পুরো উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদ হয়েছে, শাকসবজি ৪৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। আর এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ফসল পানিতে নিমজ্জিত।
\হঘোষগাঁও ইউনিয়নের ৬৮ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল কাদের যায়যায়দিনকে বলেন, বন্যা তো দেখছি, কিন্তু এইরকম বন্যা আর দেখি নাই। এই পানি আমাদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে।
কলসিন্দুর গ্রামের কাশেম আলী বলেন, আট সদস্যের পরিবার নিয়ে নেতাই নদের পাড়ের মসজিদটিতে আশ্রয় নিয়েছি। কলসিন্দুর ঘাটপাড় এলাকায় আমার বাড়ি। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও এমন পানি হয় নাই। এই বন্যা ব্যাপক ভয়াবহ। সে সময় রাস্তা ডুবাইনি আর এবার এ বন্যায় রাস্তার উপরে পানি উঠছে।
\হধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন জানান, পানি কিছুটা কমলেও শনিবার রাতভর ভারী বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। উদ্ধারকাজ অব্যাহত রয়েছে। রোববার সকাল থেকে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্থানীয়ভাবে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এদিকে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ বিতরণ করছেন।
হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলাতেও পানি ঢুকেছে। নিচু এলাকায় তলিয়ে গেছে ফসল। হালুয়াঘাট উপজেলার ভুবনকুড়া, গাজিরভিটা, ধুরাইল, কৈচাপুর, সদর ইনিয়ন ও পৌর এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বন্যায়। এদিকে ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর, ছনধরা ও রামভদ্রপুর ইউনিয়নে বন্যায় ক্ষতি হয়েছে অনেক। ডুবে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের ঘেরসহ হাজারো বাড়িঘর।
নেত্রকোনায় জলমগ্ন লক্ষাধিক মানুষ
অন্যদিকে, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে নেত্রকোনায়। সোমেশ্বরী, কংশ, ধনু, মগড়াসহ সব নদ-নদীর পানিই বাড়ছে। দুর্গাপুর, কলমাকান্দাসহ ৫ উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে জলমগ্ন হয়ে রয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। এছাড়া ১৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
রোববার দুপুরে বিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় নেত্রকোনা জেলা শিক্ষা অফিস। সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ইমদাদুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, স্কুলের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় স্কুলের শ্রেণির কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধে ভাঙন
কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে জামালপুরের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের শহর রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ কারণে জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, জামালপুর মহাশ্মশান, ব্রহ্মপুত্র নদের সেতু, বসতবাড়িসহ অনেক স্থাপনা ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে। রোববার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় বাঁধটির সিসি বস্নকসহ মাটি সরে গিয়ে প্রায় ২০ মিটার ধসে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গর্তের। সেতুর পিলারের গোড়ায় দেখা দিয়েছে ভাঙন।
ভাঙনের স্থানের আরও ফাটল ধরেছে। ভাঙনের স্থানে স্থানীয় লোকজন বাঁশ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। বাঁধের ওপর দিয়ে ওই স্থানে হেঁটে চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
জামালপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নকিবুজ্জামান খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ভাঙনের স্থানটি পরিদর্শন করা হয়েছে। দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, জামালপুর জেলার জিঞ্জিরাম নদী গোয়ালকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতির দিকে যাচ্ছে।