এবার বিএসসির 'বাংলার সৌরভে' আগুন,সন্দেহ নাশকতার
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রাম বু্যরো
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন 'বাংলার জ্যোতি'র পর এবার 'এমটি বাংলার সৌরভ' নামের আরেকটি ট্যাংকারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে একজনের মৃতু্য হয়েছে। তবে ওই নাবিক আগুনে পুড়ে মারা যাননি। অগ্নিকান্ডের পর নাবিকরা বঙ্গোপসাগরে লাফ দেন। এরপর ৪৮ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। 'বাংলার জ্যোতি'র পর 'বাংলার সৌরভ' জাহাজে অগ্নিকান্ড 'নাশকতা' হতে পারে বলে সন্দেহ করছে বিএসসি। জাহাজে আগুনের ঘটনায় ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বিএসসির বহরে আগুন লাগা জাহাজ দুইটি ৩৭ বছরের পুরনো।
শুক্রবার রাত ১২টা ৫০ থেকে ৫৫ মিনিটে কর্ণফুলী
চ্যানেল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের আলফা অ্যাঙ্গারেজে রাষ্ট্রায়ত্ত বিএসসির জাহাজ এমটি বাংলার সৌরভে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের একাধিক টাগবোট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। রাত আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
মারা যাওয়া স্ট্রয়ার্ডের নাম সাদেক মিয়া (৬০)। তিনি কুমিলস্না জেলার লাঙ্গলকোট এলাকায় মৃত ইউনুস মিয়ার ছেলে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম কার্যালয়ের মোবিলাইজিং অফিসার কফিল উদ্দিন বলেন, 'জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কল পেয়ে আমরা তেলের ট্যাংকারে আগুনের বিষয়টি নিশ্চিত হই। উদ্ধারকারী দল পৌঁছানোর আগেই আতঙ্কিত নাবিকদের বেশ কয়েকজন সাগরে লাফিয়ে পড়েন। কয়েকজনকে উদ্ধার করে ফিশিং ট্রলারগুলো। পরে আসে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা। তারা জাহাজের ৪৮ নাবিককে উদ্ধার করেন। কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাদেক নামে এক নাবিকের মৃতু্য হয়েছে।'
চট্টগ্রাম বন্দরের রেডিও কন্ট্রোলরুম সূত্রে জানা যায়, ১১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল নিয়ে নোঙরের অপেক্ষায় ছিল 'বাংলার সৌরভ'। যা পরিশোধন করার জন্য মাদার ভ্যাসেল জাহাজ থেকে খালাস করা হচ্ছিল। ট্যাংকারটিতে ক্রু ও ওয়াচম্যানসহ মোট ৫০ জন কর্মরত ছিলেন। চার ঘণ্টার চেষ্টায় অবশেষে রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিএসসি সূত্রে জানা যায়, বিএসসির বহরে রয়েছে দুইটি অয়েল ট্যাংকার। 'এমটি বাংলার জ্যোতি' ও 'এমটি বাংলার সৌরভ' নামের ট্যাংকার দুইটি ১৯৮৭ সালে নির্মিত হয়েছিল ডেনমার্কে। ট্যাংকার দুইটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ বড় ট্যাংকার থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে পতেঙ্গার বিভিন্ন ডিপোতে নিয়ে আসে।
জানা যায়, ১২-১৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে সরকার। যার মাদার ভ্যাসেল পার্ট ও লাইটারিং করে বিএসসি। বিএসসির বহরে বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি নামে দুটি লাইটারিং জাহাজ আছে। সৌরভের ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়ায় এমনও হয়েছে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা খরচ করে একটি টাগ ব্যবহার করেও লাইটারিং করা হয়।
বিএসসির সূত্রে জানা যায়, বিএসসির বহরে বর্তমানে ৭টি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি সমুদ্রগামী, যা বহির্বিশ্বের পণ্য পরিবহণে কাজ করে। বাকি দুটি লাইটার জাহাজ। লাইটার জাহাজ দুটি ১৯৮৭ সালে ডেনমার্কে তৈরি করা হয়। অপারেশনের শুরু থেকে লাইটারেজ দুটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য আমদানি করা ক্রুড অয়েল বন্দরের বহির্নোঙর থেকে খালাস করে সেগুলো ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক সূত্র জানায়, একটি জাহাজের আয়ুষ্কাল থাকে ২০ থেকে ২৫ বছর। এরপর তা আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করতে পারে না। কিন্তু এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ নামের ট্যাংকার দুইটি ১৯৮৭ সালে নির্মিত হয়েছিল ডেনমার্কে। ট্যাংকার দুটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ বড় ট্যাংকার থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে পতেঙ্গার বিভিন্ন ডিপোতে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) এমডি কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, বাংলার সৌরভ জাহাজের সম্মুখ অংশ থেকে একই সঙ্গে চার জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অথচ জাহাজে কোনো বিস্ফোরণ হয়নি। যখন জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে ঠিক একই সময়ে পাশ দিয়ে একটি স্পিডবোটও যায়। যেহেতু গ্যাস ফর্ম কিংবা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগার ঘটেনি। তাই আমরা ধারণা করছি, এটি নাশকতামূলক অগ্নিকান্ড হতে পারে। কিন্তু সবকিছু তদন্তের পরেই জানা যাবে।
বিএসসির এমডি বলেন, কয়েকদিন আগে বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগেছিল। এরপর আগুন লাগল বাংলার সৌরভে। তাই আমরা ধারণা করছি, এ ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার অপচেষ্টা। এ ঘটনায় কারা জড়িত তা শনাক্ত করা উচিত। এটি লাস্ট সার্ভিস হওয়ার কথা ছিল বাংলার সৌরভের। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন্দরের ৭টি টাগ একযোগে কাজ করে। আগুন নেভানোর দেড় ঘণ্টা পর আবার আগুন ধরে যায়।
কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, বাংলার সৌরভে ১১ হাজার ৫৫ টন অপরিশোধিত তেল ছিল। ৪৮ জন ক্রু ও ওয়াচম্যান ছিল। তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। এর মধ্যে বিএসসির স্টুয়ার্ট সাদেক মিয়া হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। বিএসসির টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে প্রধান করে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে এমটি বাংলার সৌরভ জাহাজে অগ্নিকান্ড তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন নৌপরিবহণ এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, উপদেষ্টা আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশনা দিয়েছেন।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ সালে বিএসসির 'বাংলার জ্যোতি' জাহাজটির সামনের দিকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নেভাতে কাজ করে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্ট গার্ড, কর্ণফুলী টানেল, বন্দর ও ফায়ার সার্ভিস। আগুন নেভানোর পর ৩ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। তারা হলেন- বিএসসির নিজস্ব মেরিন ওয়ার্কশপের চার্জম্যান চট্টগ্রামের নুরুল ইসলাম, ২৫-৩০ বছর ধরে বিএসসিতে ডেইলিবেসিস কাজ করা কিশোরগঞ্জের মো. হারুন, বরিশাল মেরিন একাডেমি থেকে পাস করে বের হওয়া ঝিনাইদহের ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা। আগুন নেভানোর সময় আহত হন বন্দরের কান্ডারি ১০ টাগ বোটের লস্কর মো. সোহেল রানা। তিনি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।