লঘুচাপের প্রভাবে উত্তাল সাগর
বৈরী আবহাওয়ায় থেমে থেমে বৃষ্টি, ভোগান্তি
প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
আজ সকালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টির আশঙ্কার কথা জানিয়ে চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া এ সময় ভারী বৃষ্টিজনিত কারণে পাহাড়ধসের আশঙ্কার কথাও বলেছে সংস্থাটি। এদিকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন বিকল্প নৌপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সেন্ট মার্টিন থেকে পারিবারিক কাজে টেকনাফ ও কক্সবাজার শহরে গিয়ে আটকা পড়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। অন্যদিকে, গত দুদিন ধরে টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পানিতে শেরপুরের ভোগাই ও চেলস্নাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে পড়ে জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার ৪ ইউনিয়ন ও পৌরসভায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
শুক্রবার সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মো. বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায়
রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় ও সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে।
আজ শনিবার সকাল থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানানো হয়, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ সময় সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
এছাড়া রোববার সকাল ৯টা থেকে পরের ২৪ ঘণ্টায়, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এ সময়।
এছাড়া আগামী পাঁচ দিনই বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এজন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
এদিকে, আজ শনিবার পর্যন্ত সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার (২৪ ঘণ্টায়) থেকে অতি ভারী বা ৮৯ মিলিমিটার (২৪ ঘণ্টায়) বর্ষণ হতে পারে। ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌযান চলাচল বন্ধ
'সাগর উত্তাল থাকায় দুর্ঘটনা এড়াতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে' উলেস্নখ করে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় নৌযান চলাচল শুরু হবে।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীয়া খালের পাড়ে সার্ভিস ট্রলারের টিকিট কাউন্টারে কোনো লোকজন দেখা যায়নি। পাশে কয়েকটি ট্রলার নোঙর করে রয়েছে। ট্রলারে মালামাল ওঠা-নামার কাজে নিয়োজিত কয়েকজন শ্রমিককে দেখা যায় পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদেরই দুজন আবদুস সালাম ও মোহাম্মদ হাসানের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় তাদের অলস সময় কাটছে। আয়রোজগার বন্ধ থাকায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। এভাবে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাবে।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও নৌযানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের কারণে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার নিয়মিত নৌপথটিতে ৮ জুন থেকে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ৫ ও ৮ জুন ওই নৌপথের নাইক্ষ্যংদিয়া নামক এলাকায় মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ট্রলার ও স্পিডবোট লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনার পর নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গুলিতে কেউ হতাহত না হলেও সাতটি ট্রলারে গুলি লাগে। নিয়মিত নৌপথটিতে নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার পর উপকূলীয় শাহপরীর দ্বীপের বদরমোকামের 'গোলগরা' এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।
টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, 'বিকল্প নৌপথটিতে সবসময় সাগর উত্তাল থাকে। যার কারণে নৌযান চলাচল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবু সেই পথে নৌযান চলাচল করায় সেন্টমার্টিনের বাসিন্দাদের কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকল্প পথটিতেও নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এই নৌপথে ৪৭টি সার্ভিস ট্রলার চলাচল করে, যেখানে দেড় শতাধিক মাঝিমালস্না নিয়োজিত রয়েছেন। আগামী পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই নিয়মিত নৌপথটি স্বাভাবিক না হলে সার্ভিস ট্রলারের মালিক এবং মাঝিমালস্নারা সংকটে পড়বেন।'
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, 'বৃহস্পতিবার রাত থেকে সেন্টমার্টিনে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সার্ভিস ট্রলার চলাচল দ্রম্নত স্বাভাবিক না হলে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা খাদ্যসংকটে পড়বেন।'
এদিকে সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে অনেক জেলের। টেকনাফ উপকূলে সাগরপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শত শত নৌযান সারিবদ্ধভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। এসব নৌযানের পাশে সমুদ্রসৈকতে বসে জাল মেরামত করছেন জেলেরা। কিছু নৌযানও মেরামত করতে দেখা যায়। সাবরাং মুন্ডার ডেইল এলাকার জেলে আবদুর রশিদ বলেন, এখন ইলিশের মৌসুম। তবু সতর্কসংকেতের কারণে সাগরে গিয়ে মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
টেকনাফ উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল হয়ে পড়ায় মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। তবে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ প্রজনন মৌসুম হিসেবে নদী ও সাগরে মাছ ধরা ও বিক্রয় বন্ধ থাকবে।'
শেরপুরে পানিবন্দি হাজারো মানুষ
শেরপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত উপজেলার ভোগাই ও চেলস্নাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চেলস্নাখালী নদীর পানি ২১ দশমিক ৯৫ মিলিমিটার ও ভোগাই নদীর পানি ১ হাজার ৭১৪ মিলিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থে?কে নদী দুটির পানি বাড়তে শুরু করে। রাতে পানির তোড়ে পোড়াগাঁও, নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া ও বাঘ?বেড় ইউনিয়নসহ পৌরসভার গড়কান্দা ও নিচপাড়া এলাকা পস্নাবিত হয়। এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে প্রবল বেগে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, ভোগাই নদীর তীরবর্তী নয়াবিল শিমুলতলা, ঘাকপাড়া, মন্ডলিয়াপাড়া, ভজপাড়া ও পৌরসভার গড়কান্দা ও নিচপাড়া-সংলগ্ন বাঁধে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙা অংশ দি?য়ে পানি প্রবেশ ক?রে কয়েক হাজার বাসাবা?ড়ি?তে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়ে?ছে। এ ছাড়া ভোগাই নদীর বিভিন্ন অংশে বাঁধ উপচে ও পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে নালিতাবাড়ী পৌর শহর থে?কে নয়াবিল, নালিতাবাড়ী বাজার থেকে ঘাকপাড়া যাতায়াত সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে চেলস্নাখালী নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বারমা?রি, বাতকু?চি, সন্ন্যাসীভিটা এলাকায় বাঁধ ভেঙেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া গাজিরখামার সড়ক। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাতকুচি এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এ সময় গ্রামটির মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওই গ্রামের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করেছেন নালিতাবাড়ী ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
এ ছাড়া নন্নী-আমবাগান সড়ক, নন্নী-মধুটিলা ইকোপার্ক সড়ক, আমবাগান-বাতকুচি সড়ক চেলস্নাখালী নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব সড়কে যান চলাচল বন্ধ আছে।
নন্নী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মো. আবদুলস্নাহ ব?লেন, টানা বর্ষণ ও চেলস্নাখালী নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানিতে নন্নী ও পোড়াগাঁও ইউনিয়নের যাতায়াত সড়ক ডু?বে আছে। এ ছাড়া নদীর পা?ড়ের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব দুর্গত বাসিন্দাদের উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
পানিবন্দি মানুষকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা। তিনি বলেন, 'উদ্ধার তৎপরতার জন্য সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আমাদের সংগ্রহে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার আছে। শিগগিরই পানিবন্দি পরিবারগুলোর মধ্যে এসব খাবার ও ত্রাণ সরবরাহ করা হ?বে।'