সিন্ডিকেটের কবলে জিম্মি বাজার

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া

রাজধানীর বাজারদর

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
রাজধানীর একটি বাজারে সবজি ক্রয় করছেন এক ক্রেতা -যাযাদি
প্রতি সপ্তাহেই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডিম, মাছ, মুরগি, সবজির দাম। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ টাকা বেশিতে ব্রয়লার আর ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সোনালি মুরগি। ৩০ টাকার নিচে পেঁপে ছাড়া মিলছে না কোনো সবজি। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটকেই দুষছেন ক্রেতারা। শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের চেয়ে ডজন প্রতি ডিমের দামে বেড়েছে ১০ টাকা বেশি। আর পাড়া-মহলস্নায় ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে ব্রয়লার প্রতি কেজি ১৯০ আর সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি লেয়ার মুরগি প্রতি কেজি ৩১০, কক কেজি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা। এ ছাড়া দেশি মুরগি আগের মতো ৬৫০ থেকে ৬৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও শুধু ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। বাকিগুলোর দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করে দিলেও তা বাজারে প্রতি কেজি ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা নির্ধারণ করে দেওয়া দামের চেয়ে ১০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল বাশার জানান, গণমাধ্যমের খবরে শুনেছিলাম ব্রয়লার আর সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব একবারও দেখলাম না। এদিকে, গরিবের সবজিতেও দেখা গেছে বাড়তি দাম। বাজারগুলোয় শাকসবজি ভরপুর। দোকানিরা বেগুন, শসা, পটোল, বরবটি, কচুর লতি, ঢেঁড়শ, কাঁকরল, পেঁপে, করলা, শিম, গাজর, মুলা, ফুলকপি ও বাঁধাকপির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তবে কোনোটার দামই নাগালে নেই। সবজি বিক্রেতা মহসীন বলেন, প্রতিবছর এ সময় সবজির দাম একটু বেশিই থাকে। এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মোকামগুলোয় এখন সবজির দাম বেশি। বাজারে মানভেদে প্রতিকেজি বেগুন ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৮০, ঢেঁড়শ ৫০ থেকে ৬০, বরবটি ১০০ টাকা, মুলা ৫০, কচুর লতি ৬০ থেকে ৮০, ধুন্দুল ৮০ টাকা ও পটোল ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি পেঁপে ৩০, কাঁকরল ৮০, গাজর ১২০, কচুরমুখী ৮০ থেকে ৯০ টাকা, টমেটো ১৬০, শিম ২২০-২৬০ টাকা ও শসা ৬০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি চিচিঙ্গা ৬০, প্রতি পিস ফুলকপি ৬০ থেকে ৭০, আলু কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ ও প্রতি পিস লাউয়ের জন্য গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আমিষের বাজারে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫০০ টাকা, চাষের কই ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, কোরাল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, টেংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা, চাষের পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৭০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০, দেশি কই ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা, শিং ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার ও নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের শর্ত শিথিল ও শুল্ক কমানোর পর দেশে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। আগে যে পেঁয়াজ ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো, তা এখন ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এমন দামে হতাশা প্রকাশ করে এক ক্রেতা বলেন, সরকার বদলেছে, তবে বাজার সিন্ডিকেট একই আছে। আর সিন্ডিকেটের কবলেই জিম্মি ভোক্তার পকেট। এ অবস্থা থেকে যেন আর পরিত্রাণ নেই! এর আগের দিন বৃহস্পতিবার পড়ন্ত বিকালে রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার থেকে সবজি কিনছিলেন মাহতাব হোসেন। তিনি নির্দিষ্ট একটি দোকান থেকেই নিয়মিত সবজি কেনেন। গতকালও সেখান থেকে নিহাদ আধা কেজি ঢেঁড়শ, এক কেজি আলু, আধাকেজি ঝিঙা, এক কেজি শসাসহ আরও কিছু সবজি কিনেছেন। এ সময় বিক্রেতা ফয়েজউদ্দীন নিজে থেকেই তাকে ২৫০ গ্রাম কাঁচামরিচও দেন। দাম দেওয়ার সময় নিহাদ জানতে পারেন ওই আড়াইশ গ্রাম মরিচের দাম ৭০ টাকা। তিনি বিক্রেতাকে পরিমাণ কমিয়ে ১০০ গ্রাম দিতে বলেন। অর্থাৎ এভাবেই পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে হলেও খরচের বহরে লাগাম টানার চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষ। মাহতাবের কাছে প্রতিবেদক বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় প্রত্যেকদিনই শাকসবজির দাম বাড়ছে। বেতন বাড়ে বছরে একবার। আর সবজি ও অন্য খাদ্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। বাজারে ঢুকে দাম শোনার পর ঘাম ছুটে যায়। নিহাদ জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সবসময় ফয়েজের দোকান থেকে কাঁচাবাজার নেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, চাইলেও আর চাহিদামতো পণ্য কিনতে পারছেন না। কেননা এক কেজি ঢেঁড়শের দাম উঠেছে ৮০ টাকা। বড় গোল বেগুনের দাম ১৬০ টাকা। তেজগাঁওয়ের কলমিলতা বাজারে কথা হয় আবুল খায়েরের সঙ্গে। তিনি দুই কেজি ব্রয়লার মুরগি, একটি মাঝারি মানের লাউ, আড়াইশ গ্রাম পেঁয়াজ, একশ গ্রাম রসুন, আধা কেজি আলু ও দুই আঁটি লাল শাক কিনেছেন। বাজারদর সম্পর্কে তিনি বলেন, গত সপ্তাহের চেয়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রসুন কেজিতে ৮ টাকা বেড়েছে। বলতে গেলে কোনো সবজির দামই ৬০ টাকার নিচে নেই। কলমিলতা, মহাখালী কাঁচাবাজারসহ রাজধানীর বাজারগুলোয়ও প্রায় সব ধরনের সবজির দাম গত কয়েকদিনে কেজিতে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একই অবস্থা মুরগির দামেও। কলমিলতা বাজারের সবজি বিক্রেতা পারভেজ বলেন, গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে পেঁপে ৩০ টাকা, ছোট লাউ ৪০, মাঝারি ৬০ ও বড় আকারের ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২০ টাকা বেড়ে করলা ৮০, উচ্ছে ২০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা, ১০ টাকা বেড়ে লম্বা বেগুন ৬০ টাকা, ঝিঙা ১০ টাকা বেড়ে ৮০, পটোল ৫০ থেকে ৬০, ২০ টাকা বেড়ে ঢেঁড়শ ৭০ থেকে ৮০, টমেটো ২০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারটিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি। বাজারের আরেক ব্যবসায়ী মো. বেলাল বলেন, বৃষ্টি ও বন্যার কারণে অনেক অঞ্চলে নতুন করে ফসল লাগানো যাচ্ছে না। বাজারে এখন সবজির দাম বাড়ার পেছনে বন্যা অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি কুমিলস্নাসহ নোয়াখালী অঞ্চলে বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানেও এখন ঢাকা থেকে সবজি যাচ্ছে। এর প্রভাব ঢাকার বাজারে পড়েছে। রাজধানীর বাজারগুলোয় মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৬০, করলার কেজি ৮০ থেকে ১০০, ঢেঁড়স ৮০, চিচিঙ্গা কেজি ৮০, কাঁকরল ৮০ থেকে ১০০, ঝিঙা ৭০ থেকে ৮০, বরবটি ৯০ থেকে ১০০, কাঁচামরিচ ২৮০ থেকে ৩২০, টমেটো ১৬০ থেকে ১৮০, শিম ২৩০ থেকে ২৪০ ও কচুরমুখী ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মহাখালী কাঁচাবাজারের ডিম বিক্রেতা মেহেদী হাসান জানান, ফার্মের মুরগির প্রতি হালি লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। আর ডজন ১৭০ টাকা। সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা হালি। ৫ টাকা বেড়ে হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা হালি। প্রসঙ্গত, ১৬ সেপ্টেম্বর অন্তর্র্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দিয়েছিল। সে হিসেবে প্রতি হালি ডিমের দাম পড়ে ৪৮ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করা হয় খুচরায় ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা ও সোনালি প্রতি কেজি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা। কিন্তু সরকারের নির্ধারণ করা দামে তিনটি পণ্যের কোনোটিই মিলছে না বাজারে। বাজারভেদে ব্রয়লার মুরগি ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। বাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি আমদানি করা পেঁয়াজের সরবরাহও প্রচুর, কিন্তু দামের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব নেই। খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুন ৮ টাকা বেড়ে কেজি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা এবং আমদানি করা বড় আকারের রসুন ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলুর কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আদা মানভেদে ২২০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।