ইউনূস-ইব্রাহিমের যৌথ সংবাদ সম্মেলন
মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পাবে সেই ১৮ হাজার কর্মী
সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে ঐকমত্য বন্ধুকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রধান উপদেষ্টা
প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজে যোগ দিতে না পারা সেই ১৮ হাজার বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী দাতো সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম। শুক্রবার বিকালে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ ছাড়া বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে ঐকমত্য হয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দু'দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, 'যখন আপনারা আমাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, সাত হাজার বা তার বেশিদের বিষয় বিবেচনার জন্য, যারা নিবন্ধন করেও রাজনৈতিক অবস্থা, এখানকার অভু্যত্থানের কারণে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে, আমি তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বিবেচনা করেছি।'
এই সংখ্যা ১৮ হাজার হওয়ার কথা অধ্যাপক ইউনূস মনে করিয়ে দিলে ইব্রাহিম বলেন, 'প্রথম ধাপে সাত হাজার জনের যাওয়ার উদ্যোগ দ্রম্নত নেওয়া হবে। সব সন্তোষজনক হলে বাকিদেরও ক্রমান্বয়ে নেওয়া হবে।'
চলতি বছর নতুন-পুরাতন বিদেশি কর্মীদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ৩১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানের টিকিট স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে ওই সময়ের মধ্যে যেতে পারেননি প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যেতে না পারা এই কর্মীদের নিতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে সরকারের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার কথাই জানালেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ওই ১৮ হাজার (কর্মী) সব ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে এবং এটা (যেতে না পারা) তাদের দোষ নয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও পরিবর্তন করা আমাদের দায়িত্ব।'
মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে "সিন্ডিকেটের তৎপরতা' নিয়ে এক প্রশ্নে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, 'এক্ষেত্রে অতীতের পদ্ধতি ভেঙে দিয়েছেন তারা। এখন 'স্বচ্ছ' প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগ হচ্ছে।"
"কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আমাদের উদ্বেগের বিষয় নয়। আমাদের মাথাব্যথা হলো এটা নিশ্চিত করা যে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা যেন ঠিকমতো মানা হয়। আমাদের শ্রমিক দরকার এবং তাদের প্রতি যেন 'আধুনিক দাসের' মতো আচরণ করা না হয়"-বলেও উলেস্নখ করেন তিনি।
সব দেশের কর্মীদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম থাকার কথা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, "তার মানে হচ্ছে, প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে এবং তথাকথিত 'সিলেক্টেড' লোকদেরও কঠোরভাবে নীতি মানতে হবে।"
শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা এবং কাজের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় কেউ ঘটালে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তুলে ধরে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, 'আমরা তাদের বাদ দিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছি এবং বাদও দিয়েছি।'
অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে সমালোচনা হয়, সেটা 'উচিত নয়' বলে মন্তব্য করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'অনুগ্রহ করে নিশ্চিত থাকুন যে, আমি নিজেও এই বাজে সিস্টেম এবং নির্যাতনের সিস্টেমের ভুক্তভোগী। সুতরাং এটাকে চলতে দেওয়ার কিংবা কোনোভাবে উপেক্ষা করার সরকার আমরা নই।'
বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম আরও বলেন, 'অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে আমার। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং সর্বাত্মক সহযোগী থাকব।'
আমার পুরানো বন্ধু এবং বাংলাদেশের পুরানো বন্ধু আসায় আমি খুবই খুশি উলেস্নখ করে সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, 'অন্তর্র্বর্তী সরকারে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই প্রথম কোনো দেশের সরকারপ্রধানের বাংলাদেশ সফর।'
আমরা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছি জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, 'যেখানে তারুণ্যের শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছি। সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইসু্যতে আলোচনা হয়েছে।'
চতুর্থ ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উলেস্নখ করে ড. ইউনূস আরও বলেন, 'বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয় এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রপ্তানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কথা বলেছি। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি এবং ভিসা সহজীকরণ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।'
এছাড়া আসিয়ান জোটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মালয়েশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।
'পুরানো বন্ধু' ইব্রাহিমকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ইউনূস
শুক্রবার দুপুর ২টার পর সংক্ষিপ্ত সফরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকায় পৌঁছালে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এরপর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে সেখানেই তার সঙ্গে তিনি সংক্ষিপ্ত বৈঠক সেরে নেন।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, 'পুরানো বন্ধু' আনোয়ার ইব্রাহিমকে বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে পেরে প্রধান উপদেষ্টা 'খুবই আনন্দিত'।
বিমানবন্দরে একান্ত বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রদের নেতৃত্বে অভু্যত্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেন। অভু্যত্থানে ছাত্র-নাগরিকের আত্মদান ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক 'হত্যাযজ্ঞের' বর্ণনা দেন। আলাপচারিতায় মালয়েশিয়ার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সে দেশের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।
সংক্ষিপ্ত বৈঠক শেষে দুই বন্ধু একই গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছান এবং সেখানেই তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে, শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান আনোয়ার ইব্রাহিম। তাকে স্বাগত জানান অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা ছিলেন।
৫ আগস্ট বাংলাদেশের পট পরিবর্তনের পর ১৪ আগস্ট আনোয়ার ইব্রাহিম খুব দ্রম্নত বাংলাদেশ সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানাতে ফোন করে এ ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
এদিকে, ঢাকায় মালয়েশিয়ার হাইকমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালের নভেম্বরে সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফর শেষে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।