কারা অধিদপ্তরে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম

প্রকাশ | ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

জাহাঙ্গীর আলম
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতির প্রত্যাশা ছিল সরকারি দপ্তরগুলো তাদের দোসরমুক্ত হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দুই মাস পরও কারা অধিদপ্তর চলছে বিগত সরকারের অনুগত কর্মকর্তা কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান গং-এর নিয়ন্ত্রণে। বিতর্কিত এই সেনা কর্মকর্তার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায় হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে পরিচয় দেন খুলনা জেলার মানুষ হিসেবে। খুলনা শহরের নিরালা আবাসিক এলাকায় বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি। তার শ্বশুরবাড়ি বাগেরহাট হলেও সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা থাকেন খুলনার বানিয়াখামার এলাকায়। সুজাউরের সরকারি গাড়ি থাকলেও তিনি ব্যবহার করেন আমেরিকান জেনারেল মটরসের কোটি টাকা মূল্যের জিপ গাড়ি। অভিযোগ আছে, নিয়োগ বাণিজ্যের অবৈধ কোটি কোটি টাকা তিনি পাচার করেছেন বিদেশে। এই অবৈধ অর্থে সেখানে কিনেছেন বাড়ি, যেখানে তার পরিবার-পরিজন বসবাস করেন। এই সেনা কর্মকর্তার এক শ্যালক ডা. নেওয়াজ মোস্তাফিজ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) খুলনা শাখার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নেওয়াজ ছাত্রজীবনে খুলনা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আরেক শ্যালক এনএসআই কর্মকর্তা। গোপালগঞ্জ জেলার প্রভাব খাটিয়ে এই কর্মকর্তা ভাগিয়ে নেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শকের পদ। নিয়োগ বাণিজ্য ও কারা অধিদপ্তরের ক্রয় কমিটির সভাপতি হিসেবে কারাগারগুলোতে মালামাল (কারা কর্মচারী ও বন্দিদের রেশনের তেল, কারারক্ষীদের পোশাক, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, বন্দিদের কম্বল ও বালিশ, আসবাবপত্র, কারা হাসপাতালের ওষুধ, হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি) সাপস্নাই দিয়ে গত দুই বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। তার নেতৃত্বে পরিচালিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট কারা অধিদপ্তরের সব নিয়োগ এবং ক্রয়সংক্রান্ত সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করত। কারাবিধি মোতাবেক কারারক্ষী নিয়োগের ক্ষেত্রে কারা উপমহাপরিদর্শক দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও পূর্ববর্তী সরকার তাদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে কারারক্ষী নিয়োগসহ ৩য় শ্রেণির সব নিয়োগ কারা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। নিয়োগ কমিটির প্রধান করা হয় অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও সদস্য-সচিব করা হয় সহকারী কারা মহাপরিদর্শককে (প্রশাসন)। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিয়োগবাণিজ্য সিন্ডিকেটের প্রধান হয়ে ওঠেন কর্ণেল শেখ সুজা। তার প্রধান সহযোগী ছিলেন সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া। কারা অধিদপ্তর মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে থাকে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেও কিছু জনবল নিয়োগের ক্ষমতাও কারা অধিদপ্তরের রয়েছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে কারা অধিদপ্তরের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির নজির গড়েছেন শেখ সুজাউর রহমান। জানা যায়, 'গোপালগঞ্জের মানুষ' এমন পরিচয়ের সুবাদে তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার দপ্তরের বিভিন্ন পদ-পদবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তার সুসম্পর্ক ছিল পূর্ববর্তী সুরক্ষা সেবা সচিব আবদুলস্নাহ আল মাসুদ চৌধুরীর সঙ্গেও। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে কারা অধিদপ্তরে কর্মরত ডেপুটি জেলার রুস্তম আলী, সদস্য-সচিব এআইজি (প্রশাসন) মইনুদ্দিন ভূইয়া, ডেপুটি জেলার মো. আশরাফুল ইসলাম, ডেপুটি জেলার মুশফিকুল আলম, ডেপুটি জেলার সাইদুল ইসলাম, ডেপুটি জেলার মো. ইব্রাহিম, ডেপুটি জেলার ফয়েজুর রহমান, ডেপুটি জেলার ফেরদৌস মিয়া, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শকের পি.এ হারুনর রশিদ, অফিস সহায়ক মো. ইদ্রিস আলী, অফিস সহকারী আব্দুল মালেক, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্কের গানম্যান কারারক্ষী নাজমুল হাসান, কারারক্ষী জাহিদুল আলম, কারারক্ষী লিমন চন্দ্র, কারারক্ষী মেহেদী হাসান, কারারক্ষী রাফসান জানি, কারারক্ষী নাজমুল হাসান, কারারক্ষী অলিউলস্নাহ (ড্রাইভার), কারারক্ষী রুহুল আমিন (অডিট শাখা), কারারক্ষী মোক্তার হোসেন, কারারক্ষী ইকবাল মাহমুদ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী শাওন, কারারক্ষী ইউসুফ, কারারক্ষী ও ড্রাইভার কামাল উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের কারারক্ষী ইউসুফ, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী মশিউল, কারা উপমহাপরিদর্শক দপ্তরে কর্মরত কারারক্ষী সুলতান, কারারক্ষী ও ড্রাইভার এরশাদ আলী, কারারক্ষী হাসান ইমাম, কারারক্ষী ও ড্রাইভার মুরাদ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী শাহিন আলম, ডেসপাস শাখার কারারক্ষী রুহুল আমিন, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী মো. শহীদ খান, কারারক্ষী আনোয়ার, কারারক্ষী আজিজুল ইসলাম, কারারক্ষী মাসুদ রানা ও তার বাসায় কর্মরত কারারক্ষী হাফিজ প্রমুখকে নিয়ে গড়ে তোলেন এক বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের নিউক্লিয়াস ছিলেন কারা অধিদপ্তের ছয়জন ডেপুটি জেলার। এই সিন্ডিকেট কারারক্ষী ও মহিলা কারারক্ষী নিয়োগের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় শত কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২৭ জুন কারা অধিদপ্তরে কারারক্ষী/মহিলা কারারক্ষী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ এবং ডেইলি নিউ নেশন পত্রিকায়। কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়। এতে ৩৩ জেলার ৩৫৫ জন পুরুষ ও ১৪ জেলার ১৪ জন মহিলাসহ ৩৬৯ জন প্রার্থী নিয়োগের বিষয়টি উলেস্নখ করা হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে আবেদনের শর্তাবলিতে জেলা কোটা বহাল রেখে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, আনসার-ভিডিপি কোটা, এতিম কোটাসহ ক্রমিক ৫নং বর্ণনা মতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংক্রান্ত সরকারের সার্কুলার ও বিদ্যমান বিধি-বিধান অনুসরণ করা হবে বলে উলেস্নখ করা হয়। আবেদনপত্র পূরণের জন্য একই বছরের ১১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত এক মাস সময় দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত প্রার্থীদের শারীরিক যোগ্যতা যাচাই বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। পহেলা এপ্রিল স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। ১৯ এপ্রিল শারীরিক যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২৯ এপ্রিল কারারক্ষী ও মহিলা কারারক্ষী পদে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে ২৪৩৩ জন পুরুষ ও ১৫ জন মহিলা প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। ২৪৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন করে (১৫ মে থেকে ১২ জুন পর্যন্ত) এবং ১৩ জুন ৪৮ জন পরীক্ষার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরই মধ্যে দেশে কোটা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে কারা অধিদপ্তর তড়িঘড়ি করে ১১ জুলাই কারারক্ষী নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। এতে বিভিন্ন কোটাসহ ৫৫৪ জন পুরুষ ও ১৫ জন মহিলা প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। লক্ষণীয় যে, ইতোপূর্বে ৩৩ জেলার মোট ৩৫৫ জনের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হলেও চূড়ান্ত ফলাফলে ৫৫৪ জন পুরুষ প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে পদ সংখ্যা হেরফের হতে পারে উলেস্নখ থাকলেও পরবর্তীতে আরও ১৯৯ জন পুরুষ এবং ১ জন মহিলা কারারক্ষীর পদ বৃদ্ধি পায়। পরে চূড়ান্তভাবে অতিরিক্ত যে ২০০ জনকে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। আগের ৩৩ জেলা থেকে নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও পরের ২শ' জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি না করা ও অনলাইনে আবেদনের সময় পার হয়ে যাওয়ায় বাকি ২শ' জনকেও আগের ৩৩ জেলা থেকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া করা হয়। ফলে অন্য জেলাগুলোর প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেননি। নিয়োগপ্রাপ্ত কারারক্ষীদের প্রশিক্ষণের জন্য চলতি মাসের ৮ থেকে ১০ অক্টোবরের মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশিক্ষণ একাডেমিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে একই কমিটির মাধ্যমে ৩৮৩ জনের একটি বড় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ নিয়েও অনেক বির্তক রয়েছে। যেখানে শারীরিক সক্ষমতায় আনফিট, জেলা কোটা বিবেচনায় না করা, সাধারণ কোটায় বিবাহিতদের নিয়োগসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূঁইয়ার তার সরকারি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেনি। তবে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান বলেন, 'নিয়োগের একটি নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে। যথাযথ নিয়ম-নীতি মেনে নিয়োগ হয়েছে। এই নিয়োগের একটি কমিটি আছে। আমি সিনিয়র হিসেবে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছি।' এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগে. জেনা. সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আগে কি হয়েছে আমি জানি না। যদি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'