রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় সংলাপ করতে যাচ্ছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী শনিবার ধারাবাহিকভাবে এ সংলাপ শুরু হবে। এতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফায় আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তৃতীয় দফার সংলাপে ৬ সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবগত করা হবে। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও অবগত করা হবে।
দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক বিফ্রিংয়ে এসব তথ্য জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মতবিনিময় সভা করবেন। ৮ আগস্ট অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে দুই দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিটিং হয়েছে। এটারই চলমান প্রক্রিয়ায় শনিবার থেকে আবার নতুন দফায় আলোচনা শুরু হবে। দেশের প্রধান প্রধান দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে।'
বৈঠকের মুখ্য বিষয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'যে ৬টি কমিশন হয়েছে, এর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত করা হবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বিষয়েও তাদের সঙ্গে কথা হবে। তাদের পরামর্শ নেওয়া হবে। আমরা আশা করছি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ করা হবে।'
রাজনৈতিক আলোচনার ওপর কমিশন গঠন নির্ভর করছে না জানিয়ে তিনি বলেন, কমিশনগুলোর প্রধানরা কাজ শুরু করেছেন। তাদের জন্য অফিস খোঁজা হচ্ছে। যারা যারা কমিশনের মেম্বার হবেন, সেক্ষেত্রে তাদের সম্মতি লাগে, এখন তাদের সম্মতি নেওয়া হচ্ছে।'
কতক্ষণ সংলাপ হবে বা একদিনেই সবার সঙ্গে সংলাপ হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আলোচনার দিনই সংলাপের সময় বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কোন কোন দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে- এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এটা নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টার ওপর। পুরোটাই উপদেষ্টামন্ডলী সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি যতটুকু জেনেছি, প্রধান প্রধান দলগুলোকে হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ২
আমন্ত্রণ জানানো হবে।'
এদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেবে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ নিয়ে নিজ নিজ ভাবনা থেকে প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলগুলো। নেতারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তারা সুপারিশমালা তুলে ধরবেন। এতে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধানে কী কী পরিবর্তন আনা উচিত সেসব বিষয় উলেস্নখ থাকবে।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের মাসপূর্তি উপলক্ষে গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচারবিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান। এই কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার-পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে বলে ভাষণে উলেস্নখ করেছিলেন ড. ইউনূস।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর থেকে দলীয়ভাবে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কাজ শেষ পর্যায়ে বলেও নেতারা জানান। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপিও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সমন্বয়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একইভাবে কাজ করে। দলটি এ নিয়ে যে কোনো দিন সংবাদ সম্মেলনও করতে পারে বলে জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার সরকার ঘোষিত ছয় সংস্কার কমিশনের কাজ শুরুর কথা ছিল। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। তবে গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, উপদেষ্টা পরিষদ আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করবে, এরপর ছয়টি কমিশন পুরোদমে তাদের কাজ শুরু করবে। শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদ আলোচনা শুরু করবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেন, বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার বিপস্নবের ফসল। এ বিপস্নবকে ব্যর্থ করতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র কোনোভাবে সফল হতে দেবে না রাজনৈতিক দলগুলো। সেই কারণে দলগুলো সব ধরনের সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে দলগুলো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের দাবিতে সবসময় সরব থাকবে বলেও জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, বিএনপিও এই সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা করতে সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশমালা তুলে ধরবে। আমরা মনে করি, আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার কাজ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, জনপ্রশাসন এবং বিচার বিভাগ- এই চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। যদিও গত বছর বিএনপির পক্ষ থেকে ৩১ দফা ঘোষণা করা হয়েছে।'
রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, 'সরকারের উপদেষ্টারা রাষ্ট্র সংস্কার ইসু্যতে আমাদের সঙ্গে যখন আলোচনায় বসবেন, তখন আমরা রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার উভয় ক্ষেত্রে প্রস্তাব দেব। এ নিয়ে আমরা গণমাধ্যমে কথা বলব।'
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, 'আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হলে আমরা আমাদের কথা বলব। তারা কী জানতে চাইবেন সেটার ওপর নির্ভর করবে আমরা কী বলব। আমরা অতীত থেকে বলে আসছি ভালো নির্বাচন হলেই ভালো সরকার হয় না। টু থার্ড মেজরিটি পেয়ে ২০০১ সালে এক সরকার এসেছিল আবার ২০০৮ সালে আরেক সরকার এসেছিল। বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে তাদের ফেভারে নিয়ে যায়। জাজদের বেতন বাড়িয়ে বিএনপি তাদের নিজস্ব একজন জাজকে প্রধান নির্বাহী করতে চেয়েছিল ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের। আর পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ এসে গণতন্ত্রই উঠিয়ে নিয়ে গেছে।'
কাদের বলেন, 'বিএনপি ২০০৭ সালে এক তরফা নির্বাচন করতে চেয়েছিল। পরে ১/১১ সরকার এসে তা বন্ধ করে দেয়। এক তরফা নির্বাচনে কাউকে কাউকে আনকনটেস্ট ডিক্লেয়ারও করেছিল। কাজেই একই জিনিস পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য আমরা চাই যে সংবিধান আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করুক। আইনগতভাবে স্বৈরশাসন সৃষ্টির সুযোগ আমাদের বর্তমান সংবিধানে রয়েছে। এটাকে পরিবর্তন না করে নির্বাচন দিয়ে সরকার গঠন করলে জনগণের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে না, আন্দোলনে মানুষের যে প্রত্যাশা তা পূরণ হবে না। তাই সংস্কারের জন্য যতটুকু সময় চায় অন্তর্র্বর্তী সরকার, তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি।'
জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, 'রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের সুস্পষ্ট প্রস্তাব নিয়েই তো গত কয়েক যুগ ধরে জেএসডি রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংবিধানের সংস্কারসহ শাসন পদ্ধতির বিষয়েও আমাদের প্রস্তাব রয়েছে। শাসন কাঠামো এবং শাসন পদ্ধতির সংস্কার এখন জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং সংস্কার নিয়ে যে কোনো কার্যক্রমকে আমরা অভিনন্দন জানাই। এই অন্তর্র্বর্তী সরকার জনগণের অভিপ্রায় পূরণ অর্থাৎ রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। সরকার আমন্ত্রণ জানালে আমরা আমাদের সংবিধান সংশোধন ও সংস্কার প্রশ্নে প্রস্তাব উপস্থাপন করব।'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, 'আমরা প্রথম দিন থেকে বলে আসছি কোন কোন বিষয় সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ। এগুলো শুরু করার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। আমরা দেখলাম সরকার কিছু কমিটি করেছে। তিন মাস যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। আমরা তখনই বলেছিলাম রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শুরুতেই আলোচনা করা প্রয়োজন। গত সোমবার জানতে পারলাম রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনা করবে। এটাকেও আমি পজেটিভ হিসেবে দেখতে চাই। আমাদের সঙ্গে যদি আলোচনা করেন তাহলে আমরা জানতে চাইব উনারা কী কী শুনতে চান। উনারা যেসব বিষয়ের সংস্কার শুনতে চান তখন আমরা বিস্তারিত তুলে ধরব।'
এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, 'অন্তর্র্বর্তী সরকার সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিতে চাইলে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ছাত্র-সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তাই আমরা চলমান সংস্কার কমিটি গঠন, এতে যোগ্য সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি এবং এর কার্যক্রমে পরামর্শ চাওয়াকে স্বাগত জানাই। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা বিষয়ভিত্তিক প্রস্তাব নিয়মিতভাবে দিয়ে যাচ্ছি। আমন্ত্রিত হলে অবশ্যই দেখা করে আমাদের পক্ষ থেকে দলীয় প্রস্তাব দেব। আমরা এই সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তারা সফল হোক এটা চাই।'