রাজধানীর অদূরে সাভারের শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে টানা ৫২ ঘণ্টার অবরোধ প্রত?্যাহার করেছেন শ্রমিকরা। বুধবার দুপুর ১টার দিকে পুলিশের আশ্বাসে শ্রমিকরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বকেয়া পাওনা পরিশোধের দাবিতে গত সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকার প্রবেশদ্বার গুরুত্বপূর্ণ ওই মহাসড়কটি অবরোধ করে রাখেন শ্রমিকরা। এদিকে, বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চাকরিতে পুনর্বহাল, নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুর নগরের ভোগড়া চৌধুরীবাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। এই পরিস্থিতিতে ৪০ কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
আশুলিয়া থানার ওসি আবু বক্কর জানান, ৫২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। দূরপালস্নার বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ অসংখ্য যানবাহন আটকে পড়ে মহাসড়কটির কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এর প্রভাবে পাশের ঢাকা-আরিচা ও টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড মহাসড়কেও যানজটে ভোগান্তিতে পড়েন মানুষ।
তিনি বলেন, 'শ্রমিকদের বুঝিয়ে এবং মালিকপক্ষকে তাদের মুখোমুখি করার আশ্বাস দিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।'
এদিকে, শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আমরা সবাই শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি মনিটর করছি। আশা করছি, সবাই শান্ত হবে।
জানা গেছে, গত সোমবার লে-অফ ঘোষণা করা বার্ডস গ্রম্নপের শ্রমিকদের সার্ভিস বেনিফিট ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ কোনো ধরনের পাওনাদি পরিশোধ না করে শ্রমিকদের
সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমনকি তিন মাস সময় চেয়ে কারখানার গেটে একটি নোটিশও টানিয়ে দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। সব শ্রমিক পাওনা টাকা পাওয়ার আশায় ওইদিন সকালে কারখানায় গেলে নোটিশে আরও তিন মাস সময় চাওয়ার বিষয়টি দেখতে পান। এ সময় উত্তেজিত হয়ে শ্রমিকরা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বুড়িরবাজার রোড এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। টানা দুই দিনেও সংশ্লিষ্টদের কোনো আশ্বাস না পাওয়ায় তারা অবরোধ প্রত্যাহার করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্ডস গ্রম্নপের এক শ্রমিক বলেন, 'আমাদের চুক্তির দিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিশ্বাসযোগ্য লোকজন ছিলেন। কিন্তু সেই চুক্তিও ভঙ্গ করেছে মালিকপক্ষ। আমাদের অনেক শ্রমিক চাকরি না পেয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। তারা বকেয়া পাওনাদির জন্য গ্রাম থেকে এসেছেন। এখন মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। আমাদের সবাইকে হতাশ করেছে।'
সড়কে আটকেপড়া ট্রাকচালক রহমত আলী বলেন, 'শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে রাখছে তিন দিন ধরে। মালামাল নিয়ে দুই দিন ধরে যানজটে পলাশবাড়ী এলাকায় আটকে আছি। গাড়ির চাকা কোনোভাবেই নড়ছে না। এভাবে কতক্ষণ সড়কে বসে থাকা যায়? দুই দিন ধরে ভালোভাবে খাওয়া, গোসল ও ঘুম নাই।'
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এত সময় ধরে শ্রমিকরা সড়ক বন্ধ করে রাখলেও সরকার কিংবা প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, পুলিশেরও কাউকে দুই দিনে এখানে আসতে দেখিনি। শুনলাম, শ্রমিকরা মহাসড়ক ছেড়েছে। দেখি কখন স্বাভাবিক হয়।'
গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ, ৪০ কারখানায় ছুটি
বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা গাজীপুরের চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করেছে। তবে নগরের ভোগড়া চৌধুরীবাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শ্রমিকরা। চাকরিতে পুনর্বহাল, নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে অন্তত ১০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, গাজীপুরের বেশির ভাগ কারখানার সামনে লেখা আছে 'শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ'। মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রতিটি কারখানার সামনেই শত শত শ্রমিক চাকরির জন্য ভিড় করেন। শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ থাকার কথা লেখা থাকলেও গোপনে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ শ্রমিকরা চাকরিতে যোগদান করার পর অযথা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেন- এমন অভিযোগে তারা পুরুষ শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছেন না।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ভোগরা এলাকায় শতাধিক শ্রমিক জড়ো হয়ে চাকরির দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ অবরোধ করে বিক্ষোভ-মিছিল করেন। পরে তারা বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য কারখানার ফটকের সামনে গিয়ে আহ্বান জানান। তারা সাড়া না দিলে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ভোগরা পর্যন্ত সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। ধীরে ধীরে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর রোড এলাকার কারখানাগুলোতেও শ্রমিকদের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেলমন্ড, টেকনো ফাইভার লিমিটেড, ইন্টারলিং, ইউরোমিক ট্যাক্স লিমিটেড, রুয়া ফ্যাশনসহ গাজীপুরে ৪০টি কারখানা ছুটি দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিক আলিম হোসেন জানান, 'আশপাশের যে কারখানায় যাবেন, দেখবেন সামনে লেখা আছে- লোক নিয়োগ বন্ধ আছে। অথচ তারা গোপনে লোক নিয়োগ করছে।' গত চার মাস বেকার অবস্থায় আছেন তিনি। বিভিন্ন পোশাক কারখানায় পুরুষ শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে না। অনেক কারখানায় নারী শ্রমিকদেরও ছাঁটাই করা হচ্ছে। চাকরিচু্যত শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহাল এবং পুরুষ শ্রমিকদের চাকরিতে নিয়োগের দাবিতে তারা রাস্তায় নেমেছেন।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, 'চাকরিসহ বিভিন্ন দাবিতে পোশাক কারখানার বেশ কিছু শ্রমিক ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। নগরীর ভোগড়া শিল্প এলাকার ইন্টারলিং, টেকনো ফাইভার লিমিটেড, ইউরোমিক ট্যাক্স লিমিটেড, রুয়া ফ্যাশন এবং বেলমন্ডসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার ৪০টি কারখানা ছুটি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।'
মনিটর করছি, সবাই শান্ত হবে :শ্রম সচিব
শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আমরা সবাই মনিটর করছি। আশা করছি, সবাই শান্ত হবে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। বুধবার সচিবালয়ে শিশুশ্রম প্রতিরোধ নিয়ে আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপ দলের বিতার্কিকদের সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
আশুলিয়ায় বুধবারও শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব বলেন, 'আমরা প্রত্যেকটি জিনিসই অ্যাড্রেস করছি, সেখানে ল অ্যান্ড অর্ডার যেটা আছে, সেটা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সবাই আমরা মনিটর করছি। আশা করছি, সবাই শান্ত হবে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে উৎপাদনের পরিস্থিতি যেটা দরকার, আমাদের অর্থনীতি বাঁচানোর জন্য। মালিক ও শ্রমিকপক্ষ সবাইকে অন বোড করে আমরা এটা নিরসন করব।'