বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর মায়ের আকুতি
ঋণের কিস্তি দিমু ক্যামনে...
১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গুলিবিদ্ধ হন নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদী
প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
পাঠান সোহাগ
'ছেলের পরামর্শে সমিতি থেকে টাকা তুলে একটা ঘর বানাইছিলাম। সেখানে তিনটা দরজা লাগানো হয়েছে। জানালা লাগাতে পারিনি, আস্তর, রঙ করতে পারিনি। এখন তো সংসারই চালাইতে পারছি না। ঋণের কিস্তির টাকা দিমু ক্যামনে। কিন্তু সমিতির লোকজন তো তা বুঝতে চায় না। কিস্তির অফিসার বলে, ছেলে মারা গেলে কি কিস্তির টাকা মাফ হবে? আপনি মরলে কিস্তির টাকা মাফ হইত। আলস্নাহ্ আমার ছেলেকে না নিয়ে আমারে নিয়্যা গেল না ক্যান।' এ কথা বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর মা বৃদ্ধা মাহমুদা বেগম।
\হবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদী। সেদিন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাছে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছিল। সংঘর্ষে আনুমানিক বিকাল সোয়া চারটা গুলিবিদ্ধ হন মেহেদী। সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা দিকে যাত্রাবাড়ীর কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ১৯ তারিখ শুক্রবার জুমার নামাজের পর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি ও ছোট ভাই জাহিদ আশিকের উপস্থিতে লাশ হস্তান্তর করা হয়। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার সকালে পটুয়াখালীর বাউফলে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে মেহেদীর মা মাহমুদা বেগম, 'সন্তান হারা মা কেমন থাকতে পারে। যে ছেলে সংসার চালাইত, ওষুধ কিনে দিত, বাজার খরচ চালাইত, সে মারা গেল, আমরা কেমনে ভালো থাকি।'
নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি বলেন, 'মেহেদীর গুলি লাগার ১৫ থেকে ২০ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়। গুলি লাগার পর সাড়ে ৪টা দিকে আমার কাছে
ফোন আসে। তখন আমরা জানতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমার বড় ভাইকে ফোন দেই। তারপর আমার দেবর জাহিদ আশিককে ফোন করি। আমি মাগরিবের আজানের আগে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, মেহেদীর রক্তাক্ত বডি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে রাখা আছে। আমি আমার স্বামীর এমন অবস্থা দেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমাকে তখন বলা হলো আপনি এখানে এ রবম করলে চিকিৎসা কেমন করে হবে। পরে আমাকে বারান্দায় রেখে ইসিজি করতে নেওয়া হল। ইসিজি করে জানানো হলো মেহেদী মারা গেছেন।'
২০১৮ সালে হাসান মেহেদী ও ফারহানা ইসলাম পপি সংসার জীবন শুরু হয়। এর মধ্যে দুটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তাদের নিয়ে থাকতেন কেরানীগঞ্জে এক কক্ষের ভাড়া বাড়িতে। আগস্ট মাসে দুই রুমের একটা বাসায় উঠার কথা ছিল। কিন্তু ওঠা হলো না। এখন দুই মেয়েকে নিয়ে নানা ফেরদৌস মিয়ার বাড়িতেই উঠেছেন কেরনীগঞ্জের ঘাটারবাগ এলাকায়। সাড়ে তিন বছরের মাইমুনা বিনতে নিশা ও ৯ মাস বয়সি মেহেরাজ বিন আনিশা এত অল্প বয়সে বাবাকে হারালো। এখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় মধ্যে আছেন মা ফারহানা ইসলাম পপি।
তিনি বলেন, 'এখন আর আমাদের জন্য কোনো জায়গারই দরকার নেই। এক রুমের সেই ঘরের স্মৃতিই নিয়ে থাকতে চাই। আমরা অল্প টাকার মধ্যে ভাড়া বাড়িতে সুখে শান্তিতে কাটাতাম। অল্পতেও যে সুখী হওয়া যায়, তা সংসার করতে এসে জেনে ছিলাম স্বামীর কাছ থেকে। ভাড়া বাসা ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে চলে এসেছি বাবার বাড়িতে।'
মেহেদীর মা মাহমুদা বেগম, যাত্রাবাড়ী থাকার সময় যাত্রাবাড়ী প্রাইমারি স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি একদিন স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সড়কে পানি ছিল। ড্রেনের উপর ডাকনা না থাকায় পানির মধ্যে ড্রেনে পড়ে যাই। সে সময়ে পড়ে পায়ে রড ঢুকে পরে। মেহেদীর কি কান্না, তখন দোকানের লোকজন ও ছেলে টেনে সেই ড্রেন থেকে আমাকে তুলে। সেই সময় মেহেদীর বলেছিল, মা তুমি চিন্তা করো না, আমি পড়াশোনা করে, চাকরি নিয়ে তোমারে ওষুধ কিনে দিব। ছেলে ঠিকই কথা রেখেছিল কিন্তু আমাকে রেখে আগেই চলে গেল। আমরা এখন কীভাবে চলব?'
বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ১৯৯৪-৯৫ সালে গ্রাম থেকে ঢাকা যাই। বেগুন বাড়িতে থাকি। আমি কাজ করি একটি সিগারেট কোম্পানিতে। তখন মেহেদীকে বেগুনবাড়ি স্টাফ কোয়ার্টার স্কুলে ভর্তি করি। আমার দ্বিতীয় সন্তান জাহিদ আশিকের বয়স তখন তিন মাস। মাস দুই ছেলে বাসায় রেখে আমি একদিন কাজে গেছি, ১১টার দিকে আগুন লাগে বেগুনবাড়িতে। আমি খবর পেয়ে কাজ থেকে এসে দেখি সবই শেষ। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। আমার কাছে তখন কারবালার মতো লাগছে। তিন চার ঘণ্টা খোঁজে বেগুনবাড়ি ঝিলের ওই পারে অসহায়ের মতো বসে আছে। আমি তখন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। মায়ের বুদ্ধির গুণে সেদিন আমার দুই ছেলেকে জীবিত পাইছি। এখন সেই ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেল।
মৃতু্যর পর মেহেদীর স্ত্রীকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা অনুদান দেয়। জাতিসংঘের একটি ফান্ড থেকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। নিজ উপজেলার অফিস থেকে ৩০ হাজার পেয়েছে। এছাড়া নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের অফিস থেকে প্রতি মাসে ২৫ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।
নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা অনুদান দেয়। সেখান থেকে আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা অফিস থেকে আমার ওষুধ বাবদ ১০ হাজার ও পরিবারের বাজার খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা দিয়েছিল। জাতিসংঘের একটি ফান্ড থেকে নিহতদের বাবাদের ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেটা আমি পেয়েছি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে অর্ধেক টাক দেওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে এখনো কোনো টাকা পাইনি। সেই ১০ লাখ টাকা ছেলের বউয়ের নামে দেওয়া হলেও আমাকে নমিনি দেওয়া হয়। ঢাকা টাইমসের অফিস থেকে প্রতিমাসে আমাকে ১০ হাজার ও ছেলের বউকে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। এই টাকা কত দিন দেবে সেটার কোনো ভরসা নাই।
মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি বলেন, সঞ্চয়পত্র-এর জন্য ব্যাংক নতুন হিসাব খুলতে হয়েছে। টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে। কিন্তু আয়করসহ কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিতে হয়। সেগুলো জমা দিলে টাকা উত্তোলন করতে পারব। টাকা তুলতে পারলে অর্ধেক টাকা দিয়ে দেব। সে সময় ৫০ হাজার টাকা নগদ পেয়েছিলাম সেখান থেকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা অনুদান দেয়। সেখানে ইসলামী আইন অনুসারে জামায়াতে ইসলাম ৫০ হাজার টাকা দিতে বলে বাবাকে। তখন ৫০ হাজার টাকা দেই। এতে তারা অসন্তুষ্ট হয়।
নিহত মেহেদীর বাবা মোশাররফ হোসেন জানান, তার নিজের হার্টে বস্নক (করোনারি ধমনিতে বস্নক) আছে, চারবার তিনি স্ট্রোক করেছেন। মেহেদীর ১৩ বছর বয়সি একজন ভাই আছে যে এখন মাদ্রাসায় পড়ছে। মেজ ছেলে থাকেন গাজীপুরে। পরিবারের মূল ভরসা ছিল মেহেদী। ভাইদের পড়ালেখার দায়িত্ব, বাবা-মায়ের খরচ, ঢাকা শহরে দুই সন্তানসহ পরিবারের খরচ সবটাই সামলাতেন মেহেদী। তবে তার আয় খুব বেশি ছিল না। সীমিত আয়ের মধ্যেই সবকিছু করার চেষ্টা করতেন।
তিনি আরও বলেন, 'আমি অসুস্থ ও অসহায়। আমার কোনো ইনকাম নেই। মেহদী আমাকে ডাক্তার দেখাইছে, সব কিছু করাইছে। আস্তে আস্তে সব দেনা পরিশোধ করবে। এগুলোই ওর স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন তো ভেঙে গেল।'