প্রায় মাসখানেক ধরে শ্রমিক অসন্তোষে অচলাবস্থা চলছে শিল্পাঞ্চল গাজীপুর ও আশুলিয়ায়। চলমান অস্থিরতার মধ্যে সোমবার আশুলিয়ায় যৌথবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক পোশাকশ্রমিক নিহত হন। এর পরদিন মঙ্গলবারও ফের বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুর ও আশুলিয়ায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। সকাল আটটা থেকে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক এবং আশুলিয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাইপাইল এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার শ্রমিক। এতে মহাসড়কগুলোর উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় হাজারো মানুষকে। আর আশুলিয়ায় পোশাকশ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, আশুলিয়ায় গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা সজীব মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আর শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, শ্রমিক অসন্তোষের জেরে মঙ্গলবার জেলার ৯টি কারখানা বন্ধ ছিল। এর মধ্যে ৪টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ১টি কারখানা লে-অফ, ১টি অস্থায়ী বন্ধ এবং ৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
শিল্প পুলিশ, থানা-পুলিশ ও শ্রমিকদের বরাতে গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, বকেয়া বেতনের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে গাজীপুর মহানগরীর অ্যাপারেল পস্নাস কারখানার শ্রমিকরা ভোগড়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ
\হকরে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। গত মাসের শুরুতে বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করার পর মালিকপক্ষ বেতন দিতে অপারগতা জানিয়ে সোমবার বেতন পরিশোধ করার কথা জানায়। এরপর শ্রমিকরা আর আন্দোলন করেননি। তবে সোমবার বিকালে বেতন দেয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরে রাতেই শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন এবং মহাসড়ক অবরোধ করেন। রাত ৯টার দিকে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আবারও ভোগড়া মোড়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা।
কারখানার শ্রমিক হামিদুল ইসলাম বলেন, 'কয়েক মাস ধরে কারখানা বন্ধ। কিন্তু বন্ধ হওয়ার আগে আমরা যে কাজ করেছি, সেই বেতন এখনো পরিশোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। ৩০ সেপ্টেম্বর বেতন দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে সড়কে নামতে হয়েছে।'
শ্রমিক বিক্ষোভে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় দিকে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার এবং গাজীপুরের ভোগড়া থেকে টাঙ্গাইলের দিকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েন এ দুই মহাসড়কে চলাচলকারী হাজার হাজার মানুষ।
ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'শ্রমিকরা বেতন পান কারখানায়। সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করুক। সড়কে কেন?'
ঢাকার বনানী এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন গাজীপুরের বাসিন্দা কবির হোসেন। তিনি বলেন, 'আমি নিয়মিত গাজীপুর থেকে ঢাকায় গিয়ে অফিস করি। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে কোনো যানবাহন চলাচল করছে না। পরে বাধ্য হয়ে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে উত্তরার আবদুলস্নাহপুর গিয়ে বাসে উঠে অফিসে যাই।'
এদিকে নগরের কোনাবাড়ী এলাকার এম এম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা টিফিন বিল, নাইট বিল ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে সকাল থেকে কাজ বন্ধ করে কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ করছেন।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, 'এপিএল অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার মালিকের সোমবার শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার কথা ছিল। বেতন না দেওয়ায় শ্রমিকরা সকাল থেকে বিক্ষোভ করছেন। তারা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেছেন। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।'
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, জেলার ৯টি কারখানা বন্ধ আছে। এর মধ্যে ৪টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১টি কারখানা লে-অফ, ১টি অস্থায়ী বন্ধ এবং ৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
শিল্প পুলিশ জানায়, বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ ছাড়া গাজীপুরের ৯৮ শতাংশ পোশাক কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক আছে। পোশাক কারখানাগুলোয় কর্মীরা সকালে কাজে যোগ দিয়েছেন।
আশুলিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভ অব্যাহত
আশুলিয়ায় সম্প্রতি বন্ধ ঘোষণা করা বার্ডস গ্রম্নপের চারটি কারখানার শ্রমিকরা মঙ্গলবার নবীনগর থেকে চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় বিক্ষোভ করেন। এতে সড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তিতে পড়েন হাজারো মানুষ।
পুলিশ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রোববার বার্ডস গ্রম্নপের পক্ষ থেকে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের জন্য তিন মাসের সময় বর্ধিতকরণের নোটিশ দেওয়া হয়। এতে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা উলেস্নখ করে বেতন শোধ করতে তিন মাস সময় চায়। নোটিশের পর শ্রমিকরা বকেয়া পাওনার দাবিতে বাইপাইলে নবীনগর থেকে চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। সোমবার সেখানে বিকল্প সড়কে গাড়ি চললেও মঙ্গলবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভেবে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক ব্যবহার করতে এসে অনেকে ভোগান্তিতে পড়েন। যানজট দীর্ঘ হওয়ায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশাপাশি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
বার্ডস গ্রম্নপের একটি কারখানার একজন নারী শ্রমিক বলেন, 'আমাগো বেতন না দিয়া ফ্যাক্টরি বন্ধ করল কেন? হুট কইরাই বন্ধ করছে। আমাগোরে জানায় নাই। না জানাইয়া বন্ধ দিছে। এখন আমরা আইনে যা আছে সেইভাবে পাওনা-দাওনা চাইতাছি। আমাগো পাওনা-দাওনা দিয়ে দিলে আমরা রাস্তা বস্নক করুম না। সোমবার ডেট (তারিখ) দিছিল টাকা দেওয়ার। সকাল ৮টা বাজলে গেলাম বেতন দিল না। দেখি ৩ মাস পর বেতন দিব। এইটা মাইনা নেওন যায়?'
অবরোধের কারণে নবীনগর থেকে চন্দ্রা ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যানজটের কথা উলেস্নখ করে সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আইয়ুব আলী বলেন, 'কেউ কেউ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে যানজটে আটকে আছেন। শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও এই মুহূর্তে শিল্প খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সমাধানে জোরালো চেষ্টা চলছে।'
জাবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ
এদিকে, সোমবার আশুলিয়ায় গুলিতে এক শ্রমিক নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৪ মিনিটের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সড়কের উভয় লেনে যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি পরিষেবার যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল।
অবরোধ চলাকালে নানা স্স্নোগান দেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। অবরোধে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক সোহাগী সামিয়া বলেন, 'অবিলম্বে এই হত্যাকান্ডের বিচার করতে হবে। যে হত্যাকান্ড হয়েছে, সেটা খুবই অপ্রত্যাশিত। কারণ, স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে হটানো হয়েছে বেশি দিন হয়নি। কিছুদিনের ব্যবধানে রাষ্ট্র যদি একই রকমভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় জনগণকে দমানোর চেষ্টা করে, জনগণের অধিকারবঞ্চিত করার চেষ্টা করে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।'
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক সজীব আহমেদ বলেন, 'আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেই বিশ্ববিদ্যালয় শ্রমিকের টাকায় চলে, আমার শিক্ষকের বেতন হয় শ্রমিকের টাকায়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ক্রয় করা হয় শ্রমিকের টাকায়। যার কারণে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি শ্রমিকের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়েছি। এ হত্যাকান্ডের বিচার করতে হবে। এই দায় অন্তর্র্বর্তী উপদেষ্টা সরকারকে নিতে হবে।'
গুজব ছড়িয়ে আশুলিয়ায় সংঘর্ষ :শ্রম উপদেষ্টা
অন্যদিকে, গুজব ছড়িয়ে সোমবার আশুলিয়ায় সহিংসতা ঘটানো হয়েছে দাবি করে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, সেখানে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের মধ্যে ঢুকে অনুপ্রবেশকারীরা গুলি চালিয়েছে।
মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে আশুলিয়ার ঘটনা নিয়ে কথা বলেন শ্রম উপদেষ্টা। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও ছিলেন।
আসিফ মাহমুদ বলেন, 'নারী শ্রমিককে ধর্ষণ করা হয়েছে, দু'জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে, এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয়।'
শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে উপদেষ্টা বলেন, 'ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে একটি গুজবকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে শ্রমিকদের মধ্য থেকে অনুপ্রবেশকারীরা গুলি ছোড়ে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৩ জন আহত হন। এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।'
উপদেষ্টা বলেন, 'পুরো ঘটনায় পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে রাস্তায় নামানো হয়েছে। এরপরই পরিস্থিতির অবনতি হয়।'
উসকানিদাতা এবং অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে। একই সঙ্গে শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে মডারেটর হিসেবে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে।'
নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আহত শ্রমিকদেরও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।'
মঙ্গলবারও বাইপাইল এলাকায় বেশ কিছু শ্রমিক বেতন ভাতার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'দুই-তিনটি গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এসব গার্মেন্টসের মালিকরা এখন পলাতক রয়েছেন। যেসব মালিক প্রতিশ্রম্নতি দিয়েও শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের ব্যাপারে কাজ করছেন না, তাদের ব্যাপারে আগেও বলেছি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।'
পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান শ্রম উপদেষ্টা।