ভয়েস অব আমেরিকাকে ড. ইউনূস
অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি
প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ বা আগামী নির্বাচন কবে হবে এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হলেও উপদেষ্টা পরিষদ এ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এ ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, 'আমরা আলোচনা করেছি কিন্তু সিদ্ধান্ত নেইনি।'
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আনিস আহমেদ।
এর আগে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে দেশে আগামী আঠারো মাসের মধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকার বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে যেন সক্ষম হয় সেজন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারকে তার দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কথা জানান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে এ কথা থেকে কি ধরে নেওয়া যায় যে, অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ১৮ মাস- এ প্রশ্নটি করা হলে জবাবে ইউনূস বলেন, 'সেটা আপনি ইচ্ছা করলে ধরতে পারেন। কিন্তু সরকারের মতামত তো না সেটা। সরকার তো কোনো মত দেয়নি
এ পর্যন্ত। কাজেই সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে সেটা সরকারকে বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত সেটা তো সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না।'
বিষয়টি পরিষ্কার করতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান আরও বলেন, 'আমাদেরই বলতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন তখন সেটাই হবে তারিখ।'
ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের মুখে এ বছরের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি দৃশ্যমান টানাপড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত গণ-অভু্যত্থানে ক্ষমতাচু্যত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে ইউনূস জানান, 'এটি একটি আইনগত বিষয় এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে।'
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'আমাদের দুজনেরই দুই দেশেরই স্বার্থ হলো যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝে মাঝে কতগুলা প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চির ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করল, বাচ্চা মেয়ে মারা গেল, বাচ্চা ছেলে মারা গেল এগুলো মনে কষ্ট দেয়।...এটাতে আমরা মনে করি না যে সরকার ইচ্ছা করে, ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে। যে সমস্ত কারণে এসব ঘটে সেসব কারণগুলো যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে।'
বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক গণ-অভু্যত্থানের নেতৃত্বে ছিল ছাত্ররা। অন্তর্র্বর্তী সরকারেও ছাত্রদের প্রতিনিধি রয়েছে। তবে সরকারের বাইরে যারা আছে এমন অনেক ছাত্রকে আমরা দেশের নানা ক্ষেত্রে, নানা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরাই কি দেশ চালাচ্ছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'চালানো উচিত বলছি। চালাচ্ছে বলছি না। চালানো উচিত। তরুণদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, আমি বরাবরই বলে এসছি, এখানে এ দায়িত্ব পালন করার আগে থেকেই বলছি যে তরুণদের হাতে, কারণ তারাই তাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে।'
বাংলাদেশে জুলাই মাসের এক তারিখে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দুই সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপক গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। জাতিসংঘের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রাথমিক রিপোর্টে আরও বলা হয়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ২৫০ জনের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছে।
১ লাখ ৯০ হাজার সদস্য সম্বলিত বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এখনো বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে এবং তার প্রভাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১৭ সেপ্টেম্বর দুই মাসের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা পেয়েছেন।
ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় দেড় মাস পরে, এই সময়ে সেনাবাহিনীর কমিশন অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন কেন এই প্রশ্নের জবাবে ইউনূস জানান যে, গণ-অভু্যত্থানের সময় পুলিশের ছাত্রদের হত্যা করাসহ পুলিশের গণবিরোধী ভূমিকায় জনগণের মধ্যে পুলিশের ব্যাপারে যে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয় সে কারণে গণ-অভু্যত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে যাওয়ায় পুলিশকে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাচ্ছিল না। এ কাজে আনসার নিয়োগ করেও ফল আসেনি। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, 'নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সমাবেশ হচ্ছে। তাতে বিশেষ করে আমাদের পোশাকশিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা গেল। সেগুলো নিয়ে মনে করলাম যে, এভাবে চলতে দিলে তো বাড়তে আরম্ভ করবে, তখন এ প্রসঙ্গ উঠলো যে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার জন্য।...তারা বলছে আমরা তো আছিই কিন্তু, আমাদের তো কেউ পরোয়া করছে না। কারণ আমাদের তো কোনো ক্ষমতা নেই। আমাদের একটা ক্ষমতা থাকলে তারা হয়তো আমাদের গণ্য করবে...তখন আমরা তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিলাম।'
সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২০ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, 'আমাদের মতে তখনই এ ক্ষমতা দেওয়া দরকার, যখন মনে হবে সংবিধান নিয়মের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এ সংবিধান এখনো ভালো আছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেখানে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মানে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করা।'
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংঘটিত হত্যাকান্ডগুলো, বিশেষ করে পুলিশ হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত বিচার করা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'যে যেখানে অপরাধ করেছে তার বিচার হবে। তা না হলে তো বিচার সম্পন্ন হবে না।'
এ সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সার্ক পুনরায় কার্যকরভাবে চালু করার ব্যাপারে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে জাতিসংঘ অধিবেশনের ব্যস্ততার ফাঁকে আলোচনা করা, সংবিধান সংস্কারসহ নানাক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে তার সরকারের উদ্যোগ ও অগ্রগতি, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বাঙালিদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও সহিংসতা, রোহিঙ্গা সংকট ইত্যাদি বিষয়েও কথা বলেন।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত চারজন আদিবাসী মারা গেছে। এই ঘটনায় অর্ধশতাধিকের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। এই সংঘর্ষের জেরে বহু ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বৌদ্ধ মন্দিরে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
পার্বত্য জেলাগুলোতে (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি) দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক এবং আধাসামরিক বাহিনীর সর্বব্যাপী উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে সামরিক প্রশাসন জেলাগুলোর বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির কারণ হিসাবে বলা হয় তা ঐ এলাকায় বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রিডম হাউস পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, 'এইতো আসলাম মাত্র। এতো বছরের একটা সমস্যা, আপনি দুদিনে আমাদের দিয়ে সমাধান করে দিবেন, আমরা একটা সমাধান নিয়ে আসব এটা আশা করা তো ঠিক হবে না। একটা শান্তিচুক্তি হয়েছে, সে শান্তিচুক্তি বহু বছরের চেষ্টায় হয়েছে। সেই শান্তিচুক্তি বহাল করা যাচ্ছে না। মান্য করছে না। এখন কি সে শান্তিচুক্তি আবার নতুন করে করতে হবে? সেটা আমাদের সরকার পেরে উঠবে না। এটা পরবর্তীতে নির্বাচিত যে সরকার আসবে তারা করবে।'
নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে সে ব্যাপারে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'তারা যদি আসতে চায়, আমরা তাদের আসতে দেব। আমরা তাদের গ্রহণ করব।'
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের অস্থিরতার কারণে আবার কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অনুমান করা হচ্ছে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২৫ সেপ্টেম্বর জানায়, বাংলাদেশ সীমান্তে এখনো অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে। তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানায় সংস্থাটি।
এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, 'নীতিগতভাবে আমরা কোনো রোহিঙ্গাকে নতুন করে আশ্রয় দেব না, যদিও দুঃখ লাগে কথাটা বলতে কিন্তু আমাদের জন্য সাধ্যের অতীত, আর পারব না তাদের আশ্রয় দিতে।'
অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন জনপ্রশাসন ও সংবিধান।
ভয়েস অব আমেরিকার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলি সম্পন্ন করে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা তার সরকারের মূল লক্ষ্য। সূত্র: ভয়েস অব আমেরিকা।
'সেই ফোন কল ছিল বড় চমক'
এদিকে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেওয়া অপর এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যে পরিবর্তনের জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে সেই আত্মত্যাগ অর্থবহ করতে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই আর সেই পরিবর্তনের প্রশ্নে 'সবাই ঐক্যবদ্ধ'। তার ভাষায়, 'আমরা আর পুরনো চর্চায় ফিরে যেতে রাজি নই।'
ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা উঠে এসেছে সেই আলাপচারিতায়।
ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর অভু্যত্থানকারীদের ইচ্ছায় বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী ইউনূস।
শেখ হাসিনা সরকারের যখন পতন হয় ইউনূস তখন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে, প্যারিসে আবস্থান করছিলেন। হাসিনার আমলে দায়ের হওয়া দুর্নীতি আর অর্থ আত্মসাতের মামলায় কারাগারে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন তিনি।
কিন্তু ৫ আগস্টের পর সারা বাংলাদেশের মতো ইউনূসের জীবনের গতিপথও যে বদলে গেছে, সে কথা তিনি এনপিআরকে বলেছেন।
মিশেল মার্টিন: গত গ্রীষ্মে যখন আমরা কথা বলেছিলাম, আপনি তখন দুর্নীতির অভিযোগে বিচারাধীন ছিলেন এবং এখন আপনি বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এসব কিছুই ঘটনার পালাবদল। নিজেকে এই অবস্থানে দেখে অবাক হচ্ছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: বলতে হবে, ঘটনাপ্রবাহের অদ্ভুত পালাবদল। আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে প্যারিসে ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, আমি যদি ফিরে যাই, আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, কারণ তিনি (শেখ হাসিনা) আমার ওপর ক্রোধান্বিত হবেন এবং আমাকে জেলে পাঠাবেন। তাই ভাবছিলাম ফিরতে দেরি করব কি না। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে একটা ফোন পেলাম যে, 'তিনি (শেখ হাসিনা) দেশ ছেড়েছেন। আমরা চাই আপনি সরকারপ্রধান হন।' এটা ছিল একটা বড় চমক।
মার্টিন: আপনি যখন ফোনটি পেলেন তখন আপনার মনে কী ঘটছিল?
ইউনূস: ভাবছিলাম, দেশ পরিচালনায় আমার আদৌ যুক্ত হওয়া উচিত কি না। এটা খুবই কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু ছাত্ররা যখন আমাকে ফোন করে ব্যাখ্যা করল যে পরিস্থিতি আসলে কেমন; শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, 'হঁ্যা, তোমরা এর জন্য জীবন দিয়েছ। তোমরা যদি জীবন দিতে পার, আমিও আমার অন্য সব ভাবনা বাদ দিতে পারি। আমি তোমাদের সেবায় নিয়োজিত হতে পারি, এটা আমি করব।'
মার্টিন: আপনি যখন বলেন যে তারা জীবন দিয়েছে, এটা মোটেও অতিরঞ্জন নয়, রূপকার্থেও নয়।
ইউনূস: না, এটা কোনো রূপক নয়। মানুষ মারা গেছে। প্রায় এক হাজার যুবক মারা গেল, বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বুক পেতে বুলেট নিল। আক্ষরিক অর্থে যুবকরা এসে আত্মাহুতি দিয়েছে। তারা যখন বিক্ষোভে যোগ দিতে তাদের বাড়ি থেকে বের হয়েছিল, তারা বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে এসেছিল। তারা তাদের ভাইবোনদের বিদায় জানিয়ে বলছে; 'আমি হয়তো ফিরে আসব না।' এটাই সেই চেতনা, যার মধ্য দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে। আর তারপর যেটা ঘটল, একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ বিপুল জনতা তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল।
মার্টিন: এই আন্দোলন এক দিকে খুবই অজনপ্রিয় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার প্রস্থান ডেকে এনেছে। কিন্তু পালাবদলের শুরুর দিকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে আহমদিয়া ও হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছিল। এসব ঘটনার কিছু ছিল শেখ হাসিনার দলের প্রতি তাদের আনুগত্যের কারণে। কিছু ঘটনা কেবলই সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বলে মনে হয়েছে। সেসব ঘটনা কমে এসেছে। কিন্তু তারপর থেকে আরও হামলা হয়েছে- এইবার মাজারে। আমাদের প্রতিবেদন অনুসারে সরকার পতনের পর থেকে ২০টির বেশি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, গণপিটুনিতে মানুষের মৃতু্য হয়েছে। কেন এমন হচ্ছে?
ইউনূস: জনগণ বিপস্নবের মেজাজে আছে। সুতরাং এটি একটি বিপস্নবী পরিস্থিতি। তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে; তাই তারা এমন লোকদের খুঁজছে, যারা তাদের সহকর্মীদের মৃতু্য ঘটিয়েছে। তাই জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলের অনুসারীদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। আপনি যখন বলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে, সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সুতরাং আপনি আলাদা করতে পারবেন না যে, তারা শেখ হাসিনার অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের ওপর হামলা হয়েছে, নাকি তারা হিন্দু বলে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু তাদের ওপর হামলা হয়েছে, এটা সত্যি। তারপর আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি। আমি সবাইকে বলি, আমাদের মতভেদ থাকতে পারে, তার মানে এই নয় যে আমাদের একে অপরকে আক্রমণ করতে হবে।
মার্টিন: আপনি কি মনে করেন যে আপনি জনগণকে প্রতিশোধের পরিবর্তে সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করার পথে ফিরিয়ে আনতে পারবেন?
ইউনূস: প্রতিশোধের সময় মাত্র কয়েক সপ্তাহ ছিল। কিন্তু তারপর স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে শুরু করে। তাই আমরা দেশ চালাচ্ছি। বিক্ষোভ এখনো আছে, সেগুলো প্রতিশোধের বিক্ষোভ নয়। বেশিরভাগ বিক্ষোভ তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে, তাদের চাকরির দাবিতে যাদেরকে সরকার আগে বরখাস্ত করেছিল।
তারা বলে, 'অতীতের সরকার আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে এবং আমরা বিনা কারণে আমাদের চাকরি হারিয়েছি। কারণ আমরা অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্য।' বঞ্চিতরা সবাই তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে। আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম- 'দেখুন এগুলো আপনাদের ১৫ বছরের ক্ষোভ। আমরা ১৫ দিনের মধ্যে এটি সমাধান করতে পারি না। আমাদের কিছু সময় দিন- যাতে আমরা সব ঠিক করতে পারি। আপনারা একটি খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন এবং আমাদের এটা এমনভাবে সমাধান করতে হবে, যাতে সেটা স্থায়ী হয়।'
মার্টিন: সময়ের কথা বলছি, সেনাবাহিনী আপনার পেছনে রয়েছে। সামরিক নেতারা বলেছেন, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে ১৮ মাস শাসন করতে হবে। বিরোধী দলগুলো তা চায় না। তারা নভেম্বরে নির্বাচন চেয়েছিল। আপনার যা করতে হবে তার জন্য ১৮ মাস যথেষ্ট?
ইউনূস: জনগণ এইরকম সংখ্যাগুলো বলছে; কত মাস, কত বছর লাগবে বলে তারা মনে করে। কেউ কেউ বলে যে এটি দ্রম্নত করা উচিত, কারণ আপনি যদি দীর্ঘ সময় থাকেন, আপনি অজনপ্রিয় হবেন এবং সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলেন- 'না, আপনাকে সংস্কার শেষ করতে হবে। সেজন্য আপনি দীর্ঘ সময় ধরে থাকুন, কারণ আমরা সবকিছু ঠিক না করে বাংলাদেশ ২.০-তে যেতে চাই না।' এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
মার্টিন: আপনি প্রায় পুরো নাগরিক সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার কথা বলছেন।
ইউনূস: আসলে বাংলাদেশ ২.০ বলতে ঠিক এটাই বোঝায়। আমরা পুরনো চর্চায় ফিরে যেতে চাই না। তা না হলে এত জীবন দেওয়ার মানে কী? এর কোনো মানে থাকবে না, কারণ আমরা যা করেছি (আগের সরকারে)- সবকিছু ধ্বংস করেছি। তাই একটি নতুন দেশ নির্মাণ আমাদের শুরু করতে হবে।
মার্টিন: এটা চ্যালেঞ্জিং কিন্তু দারুণ, তাই না?
ইউনূস: এটা সত্যিই দারুণ। আপনি হয়তো নেতিবাচক দিকটা দেখছেন। আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। আমি বলেছিলাম এই জাতি সবচেয়ে বড় সুযোগ পেয়েছে। পুরো দেশ, দেশের মানুষ আজ একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ- আমাদের পরিবর্তন দরকার।
মার্টিন: আপনার বয়স এখন ৮৪। আমি জানি না আপনি কখনো নিজেকে সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভেবেছেন কি না। আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশকে যে দেশে পরিণত করার আশা আপনি করছেন, সেটা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবেন?
ইউনূস: পূর্ণাঙ্গভাবে হয়তো (দেখে যেতে) পারব না। তবে আমি খুব খুশি হব (এটা জেনে যে) এটা হওয়ার পথে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক থাকবে। সঠিক নীতিতে সব চলবে। তরুণরা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ থাকবে। দেশে এবং বিশ্বব্যাপী তারা ভূমিকা পালন করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বললে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী। তবে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি সবসময় তরুণদের গুরুত্ব দিই, কারণ তারাই ভবিষ্যৎ গড়বে এবং যেভাবেই হোক তাদের নেতৃত্বের অবস্থানে থাকা উচিত।
কারণ উত্তরাধিকার সূত্রে তারাই এ গ্রহে থাকবে। আপনি বলেছেন যে আমার বয়স ৮৪ বছর। আমার সামনে খুব বেশি সময় নেই, তবে তাদের (তরুণদের) সামনে পুরো জীবন রয়েছে। সূত্র:বিডি নিউজ