বাবা কখন আসবে...

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত শামীমের অবুঝ তিন ছেলের প্রশ্ন

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
-

'অবুঝ তিন ছেলে শুধু বাবা বাবা বলে কাঁদে। বলে, বাবা কখন আসবে। কোনো বুঝই মানছে না। চকলেট, চিপস দিয়েও তাদের ভোলাতে পারছি না। একদিকে অকালে স্বামী হারানোর শোক। অন্যদিকে সংসারের রোজগার বন্ধ হওয়ায় রীতিমতো দিশেহারা আমরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে যখন সন্তানদের মুখের দিকে তাকাই, তখন আর আমার হুশ থাকে না।' টানা দুই দিনের চেষ্টার পর যোগাযোগ করা সম্ভব হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ শামীম হাওলাদারের (৩২) স্ত্রী রোকেয়া বেগম আসমার (২৭) সঙ্গে। কথাবার্তার একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বলেন শামীমের স্ত্রী। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে শামীম নামে একজনের লাশ হস্তান্তর করার তথ্য পাওয়া যায়। লাশ হস্তান্তরের যে তালিকা করা হয়েছে সেখানে শামীমের নামের পাশে শুধু একজনের মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। সেই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত শামীমের পুরো পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। মিলে যায় তার ঠিকানাও। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর থানাধীন সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ৩ নম্বর সড়কের বি-বস্নকের ১৫ নম্বর মাহবুব মিয়ার বাড়ির তৃতীয় তলার চিলেকোঠার রুমটিতে দুইজনের সঙ্গে থাকতেন। সোমবার প্রায় দশ বছর বয়সি এক ছেলের মাধ্যমে চিলেকোঠার সেই রুমটিতে পৌঁছি। অনুমান ১০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৮ ফুট প্রস্থের রুমটিতে একটি মাঝারি আকারের খাট ছাড়া তেমন কিছুই নেই। খাটের সামনে কিছু হাড়িপাতিল দেখা যায়। কাপড়চোপড় রাখার জন্য দেয়ালে পস্নাস্টিকের হ্যাঙ্গার আর রঁশি ঝুঁলানো। রুমে গিয়ে শামীমের এক রুমমেটের সঙ্গে দেখা হয়। ফরিদুল আলম (২৩) নামে সেই রুমমেট বলেন, 'মাসিক ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় শামীম ভাই, আমি ও শ্রমিক নূর আলম থাকতাম। শামীম ভাই আমার মতোই বিদু্যতের মিস্ত্রি ছিলেন। আমি আছি তিন বছর ধরে। শামীম ভাই ছিল ১০ বছর। আমরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাই নিজেরাই রান্না করে খেতাম। এতে খরচ কম হতো। টাকা বাঁচিয়ে বাড়িতে পাঠাতো সবাই।' প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ফরিদুল সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ওইদিন ছিল চলতি বছরের ২০ জুলাই শনিবার। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকের ঘটনা। শামীম ভাই বিদু্যৎ মিস্ত্রির কাজের পাশাপাশি কিছু বৈদু্যতিক জিনিসপত্র সরবরাহের ঠিকাদারি করতেন। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে পাওনা টাকা তোলেন। ওই সময় সেখানে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন চলছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছিলেন। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের হটাতে ব্যাপক গুলি চালায়। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আলস্নাহ করিম মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শামীম ভাই গুলিবিদ্ধ হন। তাকে একটি সিএনজিতে করে ছাত্র-জনতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। নেওয়ার পরপরই শামীম ভাই মারা যান। খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে যাই। পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরিবার এসে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে দাফন করে।' ফরিদুলের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় শামীমের স্ত্রীর সঙ্গে। শামীমের স্ত্রীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শামীমের পিতার নাম মান্নান হাওলাদার (মৃত)। মায়ের নাম বিউটি বেগম। বাড়ি ভোলা সদর থানাধীন পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গুপ্ত মুন্সী গ্রামে। শামীমরা ২ ভাই ৪ বোন। বোন সালমা বেগম, আসমা বেগম, হাসি বেগম ও মৌসুমী বেগমের বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী ছিল সন্তানদের মধ্যে তৃতীয়। সবার ছোট গণি হাওলাদার।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের তিন ছেলে সালমান (৮), ইমাম মাহাদী (৫) ও আলী আহমেদ (৩)। আমি তিন ছেলে নিয়ে শাশুড়ি ও দেবরের সঙ্গে বসবাস করছি। স্বামী ঢাকায় থাকত। মাঝে মধ্যে বাড়ি আসত। আমরা দরিদ্র মানুষ। আমাদের পরিবারে রোজগার করার মতো শুধু আমার স্বামীই ছিল। গণি বয়সে কিশোর। স্বামী মারা যাওয়ার পর আমাদের আয়রোজগার সব বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকটাই পথে বসার জোগাড় হয়েছে।' এই বলেই তিনি কাঁদতে থাকেন। বলেন, 'একদিকে অকালে স্বামী হারানোর শোক। আরেকদিকে অভাব। তারপর তিনটি অবুঝ ছেলে সারাক্ষণ শুধু বাবা বাবা বলে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে খানিক পরপরই ছেলেরা বলে বাবা কখন আসবে। তা জানতে চায়। ছেলেদের চকোলেট, চিপস দিয়ে নানা কথায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের মন ভোলানো যায় না। তাদের বাবাকে বাড়িতে এনে কবর দেওয়া হয়েছে, তা দেখেও তারা বিশ্বাস করতে চায় না। আসলে তারা তো বুঝেই না, তাদের বাবা আর দুনিয়ায় নেই।' এই বলেই তিনি আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, 'আমরা খুবই দরিদ্র মানুষ। পরিবারটিকে বাঁচাতে রাষ্ট্র যেন আমাদের পাশে থাকে।' এছাড়া এমন হত্যাকান্ডের বিচারও দাবি করেন তিনি। সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি। এমনকি সরকারের তরফ থেকে কেউ যোগাযোগও করেনি। শুধু জামায়াতে ইসলামী তার পরিবারকে নগদ দুই লাখ টাকা দিয়েছে। স্বামীর মৃতু্যর ঘটনায় তিনি মামলা করতে চান। তবে শাশুড়ির আপত্তির কারণে তিনি মামলা করতে পারেননি। শাশুড়ির কথা, মামলা করলে লাশ আবার কবর থেকে তুলবে, কাঁটাছেঁড়া করবে, সেটি তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই তিনি মামলা করতে নিষেধ করেছেন। যে কারণে আর মামলা করতে পারেননি। তারপরও তিনি এমন হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। 'বেঁচে থাকতেই আলস্নাহ যেন আমাকে আমার স্বামীর হত্যাকারীদের শাস্তি দেখায়' এই বলেই তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন।