আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ
আশুলিয়ায় গুলিতে শ্রমিক নিহত
মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, বন্ধ ১৮ কারখানা অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ : মালিকপক্ষ
প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
রাজধানীর অদূরে সাভারের শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় গুলিতে কাওসার হোসেন খান (২৭) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ৫ জন। আহতদের সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংঘর্ষের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার দুপুরে আশুলিয়ার টঙ্গিবাড়ী এলাকায় মন্ডল গ্রম্নপের কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে। শ্রমিক নিহতের ঘটনায় শিল্পাঞ্চলে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।
এদিকে, সকালে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল ও ডিওএইচএস পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন দুটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। সার্ভিস বেনিফিট ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করা ও বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে এই বিক্ষোভ চলছে। অন্যদিকে, সোমবারও ১৮ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়।
সোমবার সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ শ্রমিক কাওসার হোসেন খান ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড নামে একটি কারখানার সুইং অপারেটর ছিলেন। তার বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উপজেলার মধ্য রতনপুর এলাকায়। আহতরা হলেন- আশুলিয়ার ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক হাবীব, ন্যাচারাল ইন্ডিগো লিমিটেডের মো. নাজমুল হোসেন, মো. ওবায়দুল মোলস্না, ন্যাচারাল গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক রাসেল মিয়া ও নয়ন।
সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনচার্জ মো. ইউসুফ বলেন, দুপুরে গুলিবিদ্ধ ৫ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ বাকি ৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, সকালে মন্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানা খুলে দেওয়া, দুজন শ্রমিক নিখোঁজের অভিযোগ ও শ্রমিকদের মারধরসহ নানা বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ আলোচনায় বসে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা বাইরে বের হয়ে আসেন। এ সময় পাশের ন্যাচারাল ডেনিম ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে মন্ডলের শ্রমিকদের আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে- এমন কথা ছড়িয়ে পড়ে। পরে এ দুটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে মন্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় আশপাশের কিছু
কারখানার শ্রমিকরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ধাওয়া দেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময়গুলোতে কয়েকজন আহত হন। এ ছাড়া উভয় পক্ষের অন্তত ১০-১৫ জন আহত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর একজন কর্মকর্তা বলেন, 'বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ির কাচ ইটপাটকেল ছুড়ে ভেঙে ফেলেছে। শিল্প পুলিশের এসপি, র?্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে।'
ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার একজন শ্রমিক সুমন মিয়া বলেন, 'মজুরি নিয়া সমস্যা, দুজন শ্রমিক নিখোঁজ এসব নিয়া মন্ডল কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে আমরা গেছিলাম। মন্ডলের শ্রমিকদের আটকাইয়া মারধর করতেছে এটাও শুনছিলাম। বেলা ১১টার দিকে ওইখানে গেছিলাম, ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানার শ্রমিকরাও গেছিল। ওইখানে যাওয়ার পর প্রশাসন ও সাধারণ শ্রমিক মুখোমুখি হয়। দুই পক্ষেরই পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। শ্রমিকরা যখন গাড়ি ভাঙচুর করছে, ওদের ওপর চড়াও হইছে, তখন তারা গুলি ছুড়ছে। দেখছি তিনজনের গুলি লাগছে। একজন মারা গেছে। দুজনরে এনাম মেডিকেলে নিয়া রাইখা আসছি।'
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, 'গত কয়েক দিনে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজকে একজন শ্রমিক নিহত ও একাধিক শ্রমিকের আহতের ঘটনা কাম্য নয়। যেখানে সমস্যা সমাধান হয়ে যাচ্ছিল, সেখানে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন মন্ডল নিটওয়্যারে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল। দ্রম্নত এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে, না হলে এ শিল্প খাতটি গভীর সংকটের মুখে পড়বে।'
নিহতরা পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন কি-না জানতে চাইলে সাভার থানার ওসি জুয়েল বলেন, 'তাদের মৃতু্য গুলিতে না কিভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।'
এ বিষয়ে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলমের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিক
বিক্ষোভ, বন্ধ ১৮ কারখানা
সোমবার সকাল নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল ও ডিওএইচএস পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ডংলিয়ন ও বার্ডস গ্রম্নপের শ্রমিকরা। সার্ভিস বেনিফিট ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করা ও বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে তারা বিক্ষোভ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৭ আগস্ট এক নোটিশের মাধ্যমে বার্ডস গ্রম্নপ লে-অফ ঘোষণা করেন। এই নোটিশে লেখা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেশ কিছুদিন যাবৎ কারখানাতে কোনো প্রকার কাজ নেই। এরপরও কারখানা কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে আর্থিক লোকসানের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছিল। শতচেষ্টা করেও নতুন কোনো কাজের অর্ডার সংগ্রহ করতে পারেনি, যা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। এ অবস্থায় ২৮ আগস্ট থেকে গ্রম্নপটির আর এন আর ফ্যাশনস লি., বার্ডস গার্মেন্টস লি., বার্ডস ফেডরেক্স লি. এবং বার্ডস এ অ্যান্ড জেড লি.-এর সব সেকশনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শ্রমিকরা জানান, ২৭ তারিখের ইসু্য করা নোটিশের মাধ্যমে ২৮ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার বার্ডস গ্রম্নপের সব কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়। এসময় শ্রমিক-কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ ও সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ ৩০ সেপ্টেম্বর পরিশোধের দিন ধার্য করা হয়। চুক্তিমতো শ্রমিকদের বেতনের টাকা পরিশোধ করলেও ৩০ সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের আরও তিন মাস সময় চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্ধারিত টাকা পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এদিকে শ্রমিকদের টাকা পরিশোধ না করলেও শ্রমিক নেতাদের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা উৎকোচ হিসেবে প্রদান করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা বলেন, শ্রমিকদের নির্ধারিত পাওনাদি পরিশোধের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ধার্য করা ছিল। এই তারিখ পিছিয়ে আরও তিন মাস সময় চান কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের বুঝিয়ে এই তিনমাস সময় নিয়ে দিতে শ্রমিক নেতারা ২০ লাখ টাকা দাবি করেন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে ১২ লাখ টাকায় রফাদফা হয়। গতকাল ২৯ সেপ্টেম্বর ৪ শ্রমিক নেতা কারখানার আইনজীবী 'আমেনার' সঙ্গে মিটিং করেন। পরে বার্ডস গ্রম্নপের পক্ষ থেকে তিনমাস সময় চেয়ে একটি নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশের খবর শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'বার্ডস গ্রম্নপের শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন।'
অন্যদিকে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় আজ সকাল থেকে অধিকাংশ পোশাক কারখানা খোলা রয়েছে জানিয়ে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো সারোয়ার আলম বলেন, 'আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় নো ওয়ার্ক নো পে'র ভিত্তিতে ১১টি, এবং ৭টি কারখানায় সাধারণ ছুটি রয়েছে। শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে যৌথবাহিনী।'
অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা
দিতে ব্যর্থ : মালিকপক্ষ
এদিকে, চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে সোমবার রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে 'ঢাকার আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ' হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কারখানার মালিকরা।
শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার পরও নাশকতার দায় কার- এমন প্রশ্ন রেখে মালিকরা বলেন, 'যে কারখানাগুলো মাসের বেশিরভাগ দিন বন্ধ ছিল, সেখানে বেতন পরিশোধ করাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বাইরের সংকটের কারণে ভালো কারখানাগুলোও উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে।'
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর আশ্বাসের পরও নিরাপত্তার ব্যাপক ঘাটতি আছে উলেস্নখ করে মালিকরা জানান, এখনো ঠুনকো কারণে কারখানায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রোববার কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর করা হয়েছে। লিড সার্টিফাইড কারখানাতেও আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
কারখানা আক্রান্ত হলে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কাছে সহায়তা চেয়েও নিরাপত্তা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করে তারা বলেন, 'শ্রমিকরা ভাঙচুর করবে, অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে, আবার তাদের বিচার করা যাবে না, এটা হতে পারে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ শিল্পকে সচল রাখা কঠিন হবে।'
মালিকরা দাবি করেন, অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন। অনেক ক্রেতার কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে এয়ার কার্গোতে পাঠাতে হচ্ছে, যেখানে হাজার হাজার ডলার মাশুল গুনতে হচ্ছে।