আমার আর ঘুম হয় না!
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ রাজুর শোকাহত বাবার স্মৃতিচারণ
প্রকাশ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
'ধরে নিয়ে গুলি করে এভাবে কাউকে হত্যা করতে কোনো দিনই দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এভাবে মানুষকে হত্যা করতে পারে না। এমন দৃশ্য দেখলে যে কারো গা শিউরে উঠতে বাধ্য। ওই ভিডিও দেখার পর থেকে আমার আর ঘুম হয় না'।
হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দাবি করে ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ ছাত্র রাজু আহমেদের (২৪) বাবা কালাম মোলস্না (৬০)। তিনি আরও বলেন, 'আমি পরিবার নিয়ে মাগুরা সদর থানাধীন জগদল এলাকার আজমপুর গ্রামে বসবাস করি। আমার স্ত্রীর নাম নাসিমা বেগম (৪৭)। আমার বড় ছেলে নাজিম উদ্দিন বিবাহিত। বড় ছেলের ঘরে কোনো সন্তানাদি হয়নি। দ্বিতীয় সন্তান ছিল রাজু। রাজু মাগুরা আদর্শ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় যায়। সেখানে জননী কুয়িরার সার্ভিস নামের একটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়। অফিস মোহাম্মদপুরের চাঁন মিয়া হাউজিং এলাকায়। এজন্য বাসা নিয়েছিল ওই এলাকাতে। যাতে করে অফিসে যাতায়াত করতে সুবিধা হয়। খরচ কম পড়ে। যে কারণে পরিচিতদের সঙ্গে ঢাকার মোহাম্মদপুরের চাঁন মিয়া হাউজিং এলাকার একটি বাসায় ভাড়ায় থাকত।'
তিনি আরও বলেন, 'সবার ছোট মেয়ে সীমা খাতুন (২০)। তাকে বিয়ে দিয়েছি। তার সংসারে দুই সন্তান আছে। এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সীমা। আমরা গ্রামে থাকি। আমি মূলত কৃষক। গ্রামেই কৃষিকাজ করি। নিজেদের তেমন কোনো জমিজমা নেই। তাই অনেকটা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে। আমরা সত্যিকার অর্থেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নিজে চেষ্টা করেও সন্তানদের তেমন ভালো পড়াশোনা করাতে পারিনি। যতটুকু করাতে পেরেছি, তাতে জীবন একপ্রকার বের হয়ে গেছে। বহু কষ্টে সন্তানদের কিছুটা পড়াশোনা করাতে সক্ষম হয়েছি।'
তিনি স্থানীয় লোকজন ও ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার বরাত দিয়ে বলেন, চলতি বছরের ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনা। ওইদিন অফিস
বন্ধ ছিল। রাজু বাসাতেই ছিল। মোহাম্মদপুর চার রাস্তা মোড়ে বাসস্ট্যান্ডে ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন চলছিল। তাই দেখতে বাসা থেকে বেরিয়ে চাঁন মিয়া হাউজিং এলাকায় থাকা কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসের সামনে যায়। সেখান থেকেই আশপাশের এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি দেখছিল। মূলত উৎসুক জনতা হিসেবে রাজু সেখানে গিয়েছিল। সে সময় প্রচন্ড গুলি চালাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময় রাজু অন্যান্য উৎসুক জনতার সঙ্গে মিলে চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের ১ নম্বর গেটের ওরিয়েন্টাল কোভেন ভবনের সামনের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল।
তিনি বলেন, ভিডিওতে দেখা যায় একজন আনসার প্রথমে সেখানে দৌড়ে আসেন। তিনি এসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনদের মধ্যে প্রথমেই রাজুকে শার্টের কলার ধরে খানিকটা সামনে নিয়ে যান। এরপর তার পা লক্ষ্য করে গুলি চালান। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজু চিৎকার করতে করতে সেখানে পড়ে যায়। এর পরপরই আরেকজন পুলিশ সদস্য রাইফেল নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সেখানে হাজির হন। তিনি গিয়ে কোনো কিছু না বলেই সোজা সেখানে পড়ে থাকা রাজুর বুকে গুলি চালিয়ে দেন। মুহূের্তর মধ্যেই রাজু সেখানে লুটিয়ে পড়ে। বুক থেকে রক্ত বেরিয়ে পা পর্যন্ত ভিজে যায়। পরে সেখানকার লোকজন রাজুকে সিএনজিতে তুলে শেরেবাংলা নগর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা রাজুকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে এভাবে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করতে পারে, কোনো দিন দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এতটা নির্দয় হতে পারে কোনোদিন ভাবিনি। আমি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ কঠোর শাস্তি চাই। একইসঙ্গে সরকার যেন আমার পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। এ ছাড়া সরকারের কাছে তিনি বড় ছেলের জন্য একটি চাকরির দাবি করেন। যাতে করে অন্তত তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারেন। সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি বলেও দাবি করেন তিনি।
অনেকটা খোঁজাখুঁজির পর রাজুর কর্মস্থল জননী কুরিয়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর থানাধীন বাঁশবাড়ির ওরিয়েন্টাল কোভেন হাউজের ৩/৩ নম্বর অফিসের সন্ধান মিলে। সেখানে গেলে কথা হয় তার সহকর্মীদের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন বলেন, মাত্র ৩ মাস হলো রাজু চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। তার মধ্যে দুই মাসের বেতন নিয়েছে। দুই মাস শেষেই ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন অফিস বন্ধ ছিল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অফিস বন্ধ রাখা হয়েছিল। একই সঙ্গে সবাইকে নিরাপদে থাকতে বলা হয়। রাজুর বাসা কাছাকাছি থাকায় উৎসুক জনতার সঙ্গে মিশে অফিসের কাছে অবস্থান নিয়েছিল। সেখানেই ঘটনাটি ঘটে।
জননী কুরিয়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, জননী কুরিয়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর অফিসের অধীনে চাকরি করেন শহীদ রাজু আহমেদের চাচাতো ভাই রাকিব আহমেদ (২৪) ও মামাতো ভাই সুমন হোসেন (২৫)। রাকিব জননী কুরিয়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর থানাধীন বছিলা এলাকার ঘাটারচরে অবস্থিত শাখায় চাকরি করেন।
জননী কুরিয়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুরের ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন বলেন, মোহাম্মদপুরের বছিলা ও ঘাটারচরসহ পুরো এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন আরও তীব্র ছিল। যে কারণে মোহাম্মদপুর এলাকার সব শাখা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। রাজু অফিসের কাছেই ভাড়ায় থাকতেন। অন্যান্য উৎসুক মানুষের মতো রাজুও ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেখতে গিয়ে শহীদ হন।
শহীদ রাজুর চাচাতো ভাই রাকিব জানান, রাজু মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতন পেত। প্রকৃত পক্ষে রাজুসহ আমরা দরিদ্র ঘরের সন্তান। রাজু ডিগ্রি পাস করেছিল। মাস্টার্স শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাসাতে থেকেই আমি রাজুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাই। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি রাজু মারা গেছে। পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়।
এ ব্যাপারে রাজুর পিতা বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের ৪৬ জন নেতার নাম উলেস্নখ করে এবং অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। রাজুর পিতা দাবি করেন, দায়েরকৃত মামলাটির এজাহার একজন আইনজীবী লিখে দেন। বাদী হিসেবে শুধু আমি নিজের নাম স্বাক্ষর করেছি।