রদবদল ফাঁদে স্থবির প্রশাসন

প্রকাশ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই তীব্র সমালোচনা চলছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলে সাজানো প্রশাসন নিয়ে। অনিয়ম-দুর্নীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাত ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে এ প্রশাসনের আমূল পরিবর্তনের দাবিও ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত শুরু হয় রদবদলের পালা। পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে আওয়ামী লীগের তকমাধারী কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের পদায়ন কার্যক্রমেও নতুন গতি পায়। তবে দীর্ঘ সময় ধরে এ রদবদল প্রক্রিয়া চলমান থাকায় পুলিশ ও জনপ্রশাসনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। যা দ্রম্নত কাটিয়ে ওঠা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, সংস্কারের যে টার্গেট নিয়ে এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তা পূরণ করতে হলে প্রশাসনিক স্থবিরতা দ্রম্নত কাটিয়ে উঠতে হবে। তা না হলে মূল লক্ষ্য থেকে দূরে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে প্রশাসনে রদবদলের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। কেননা এমনটি ঘটলে স্থবির প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। যদিও শীর্ষ প্রশাসনের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে জানায়, টানা ১৫ বছরের ক্ষমতার মেয়াদে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদ যেভাবে ঢেলে সাজিয়েছে তার আমূল পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দরকার। তবে এতে প্রশাসনিক কার্যক্রমে যাতে কোনো ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই ধাপে ধাপে রদবদল কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে। এরইমধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মোট ১৯ জন পূর্ণ সচিবের মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ১১ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে গত ৩ সেপ্টেম্বর চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের ২৪ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করে সরকার। কয়েকজন সচিবকে ওএসডি ও অবসরে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ যে আটটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এর মধ্যে বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্তও আছে। বিশেষ করে যেসব নিয়োগ নিয়ে বেশি বিতর্ক আছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর পর্যায়ক্রমে সব চুক্তি বাতিল করা হবে। এর পর থেকে সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে শুরু করে সরকার। এদিকে, বিগত ১৫ বছর প্রশাসনে বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন যারা, তাদের ন্যায্যতা ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট ২৮তম-৪২তম বিসিএসে ক্যাডার পদে নিয়োগবঞ্চিত ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দলীয় আনুগত্যের বদৌলতে বিগত ১৫ বছর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকসহ মাঠপ্রশাসনে বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে যারা বিগত তিন সরকারের এমপি, মন্ত্রীদের পিএস ছিলেন, তাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এ ধরনের রদবদল প্রক্রিয়া চলমান থাকায় প্রশাসনিক স্থবিরতা কাটতে সময় লাগছে। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনে আগামীতে আরও পরিবর্তন আসছে। প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরলে কয়েকজন সচিব প্রত্যাহার ও নতুন পদায়ন হতে পারে। এ ছাড়া অধিদপ্তরের প্রধান পদে নতুন পদায়ন হবে। প্রত্যাহারও হবেন কয়েকজন বলে জানান জনপ্রশাসন সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরলে আমাদের কিছু সামারি যাবে। আমরা এগুলো রেডি করছি। কিছু সচিব উইথড্র হবে। নতুন কিছু সচিব পদায়ন হবে। বিভাগীয় এডিশনাল লেভেলে বদলি হবে। এবং আমাদের বিভিন্ন করপোরেশন সেক্টরের চেয়ারম্যান ডিজি এই সমস্ত পদ এগুলো পূরণ হয়ে যাবে।' তিনি বলেন, নতুন ডিসিদের কেউ সক্ষমতা প্রমাণ করতে না পারলে প্রত্যাহার হতে পারেন। শূন্য থাকা ৮ জেলার ডিসি নিয়োগ হবে দ্রম্নত। রদবদল হতে পারে এডিসি ও ইউএনও পদেও। এদিকে কয়েকটি মন্ত্রণালয় এখন সচিব শূন্য। আবার বেশকিছু মন্ত্রণালয়ে থেকে গেছেন বিগত সময়ের সুবিধাভোগীরা। অন্যদিকে ক্ষমতার পালাবদলে ৫১ জেলায় যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছেন নতুনরা। অভিযোগ থাকায় নিয়োগের পরদিনই বাতিল হয় ৮ জেলার নতুন ডিসি নিয়োগ। তাই ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে এসব জেলা। আবার উপসচিব পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার ক্ষোভ ও অভিযোগ আছে নতুন ডিসি নিয়োগ নিয়ে। সচিব বলেন, 'যারা ডিসি হিসেবে নতুন নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা ফিট, তারা ফর দি পিপল, ফর দা স্টেট। আমরা একই সঙ্গে ৫১ জনকে একই সময় নিয়োগ দিয়েছি, তারা খুব কনফিডেন্টের সঙ্গে কাজ করছে। যেহেতু আটজন ডিসিকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, সেখানে দ্রম্নত নতুন ডিসি পদায়ন করা হবে। এদিকে মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘ সময় ইউএনও ও এডিসির দায়িত্বে আছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রয়োজনে বিভাগীয় কমিশনরা ব্যবস্থা নিতে পারে বলে জানিয়েছেন সচিব। তিনি বলেন, 'ডিভিশনাল কমিশনার ফিল করছেন, উনাকে অথরিটি দেওয়া আছে। উনি বদলাচ্ছেন, উইথড্র করছেন। এ ধরনের নানা পদক্ষেপের কারণে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। ডিভিশন লেভেলটা ফাইন আর সেক্রেটারিয়েট তো শুধু একটা মিনিস্ট্রি কাজ করে না। এখানে নানান ধরনের অস্থিরতা দেখা গেছে। এখন অস্থিরতা আস্তে আস্তে স্তমিত হচ্ছে। এবং ইট ইজ ফাংশনাল।' সচিব জানান প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে কঠোর সরকার। ১ অক্টোবর শুরু হচ্ছে প্রশাসন সংস্কারের কার্যক্রমও। সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বুঝে শুনে নেওয়া উচিত এবং নিলে আর পরিবর্তন না করা ভালো। কারণ পরিবর্তন করলে একটা খারাপ বার্তা যায়। তারা গুছানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু একটু সময় লাগছে। আমি তো মনে করি এটা হয়তো আগামী এক মাসের মধ্যে সব গুছিয়ে ফেলবেন।' এদিকে রদবদলের ফাঁদে পুলিশ প্রশাসনেও এখনো এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক রাজনীতিকরণ এবং দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য অভিযুক্ত হয়েছে পুলিশ বাহিনী। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর থানায় হামলা, ভাঙচুর, হত্যাসহ নানা কারণে দেশজুড়ে পুলিশের প্রায় সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভেঙে যায় সদস্যদের মনোবল, স্থবির হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। এ কারণে আন্দোলনকারীসহ বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশে সংস্কারের জোরালো দাবি ওঠে। কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দুই মাস হতে চললেও পুলিশের ভাবমূর্তি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উলেস্নখযোগ্য উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ছে না। দৃশ্যত পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নের তৎপরতাই চলছে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ পদে ও স্থানে পদায়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে সংস্কারে জোর দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, 'সংস্কারের বিষয়টি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটু ধৈর্য ধরতে হবে, সময় দিতে হবে।' এদিকে পুলিশের সংস্কারের ওপর জোর না দিয়ে পদোন্নতি ও পদায়নের 'প্রতিযোগিতায়' সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। গণ-আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজেও এ নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট দেখা গেছে। গ্রম্নপে অভিযোগ করা হয়েছে, পুলিশের পদোন্নতি, পদায়ন বা বদলির বিষয়টি 'গত সরকারের আমলের মতো' আবার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হতে চলেছে। পদোন্নতি, পদায়ন বা বদলি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। যদিও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক আহমেদের ভাষ্য, 'নানাজন নানা বিষয় বলতেই পারে। আমরা আমাদের কাজটা করছি। পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যে বিশৃঙ্খলা হয়েছে, পুলিশের পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে সেই ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।' প্রসঙ্গত, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অফিসার পদমর্যাদার অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের বদলি বা পদায়ন হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ের কনস্টেবল বা নিচের দিকের কর্মীদেরও বদলি করা হচ্ছে। সংস্কারের অংশ পুলিশের ডজন দুয়েক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকা রাখা প্রায় ৮০ জন পুলিশ সদস্যকে ওএসডি করা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ কনস্টেবল থেকে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পর্যন্ত পর্যাপ্ত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাদের কর্মস্থলও রদবদল করা হয়েছে। পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের সময় পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন বলে দাবি করছেন। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, 'পদোন্নতি ও পদায়ন যা করা হচ্ছে, এগুলো সংস্কারের অংশ নয়, প্রশাসনিক ব্যাপার। সংস্কার হচ্ছে মৌলিক পরিবর্তন করা। আইনকানুন পরিবর্তন, নিয়োগপ্রক্রিয়া ঠিক করা, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা পুলিশের লোক, নাকি স্বাধীন কোনো সংস্থা দেখবে; এগুলো ঠিক করা। পদায়ন, পদোন্নতি এখনকার মূল কাজ নয়। অন্য কাজগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা জরুরি।' পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, 'জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়ে তা দৃশ্যমান ও বাস্তবায়ন করা উচিত। সংস্কারের শুধু একটি দিকে জোর দিয়ে কতিপয় বঞ্চিত পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি ও পদায়ন করে বাহিনীর সার্বিক মনোবল বৃদ্ধি এবং জনগণের আস্থা অর্জনে বিশেষ কাজে আসবে না। কাটবে না প্রশাসনের স্থবিরতাও।