'পরিবারে ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় নাসির। সে সময় পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আমি শ্রমিকের কাজ করতাম। আমার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন। তাই ছোটবেলায় হাতের কাজ শিখিয়ে নাসিরকে দর্জির কাজে দিতে হয়। আমার আর ছেলের আয়েই চলত ১১ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ। ছোট ভাই-বোনদের এত ভালোবাসত, তাদের ভালো রাখতে সব সময় কাজে ডুবে থাকত। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও শুধু বিয়েটা করাইতে পারি নাই। এখন পারিবারিক সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেল নাসির।' এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত মো. নাসির হোসেনের বাবা মো. রফিকুল ইসলাম।
স্মৃতিচারণ করতে করতে নাসিরের মা নাজমা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, 'নাসির নিজেই নিজের শার্ট-প্যান্ট বানাইত। আমার, ছোট ভাই-বোনদের জামা কাপড়, থ্রি-পিস বানাইত। তার কাপড় বানানোর হাত খুই ভালো ছিল। এখন কেউ আর এসে বলবে না, মা তোমার জন্য থ্রি-পিস বানাইয়া আনছি। আমি আর নাসিরের বানানো কোনো কাপড় দেখতে পাব না। তাই ছেলের রক্তমাখা শার্টখানা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় 'কমপিস্নট শাটডাউন' কর্মসূচি চলাকালে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। হাতে কোনো কাজ না থাকায় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন নাসির। এর পরের দিন ২০ জুলাই মুখমন্ডলে, কপালে ও চিপে গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে মাতুয়াইলে এসএমসি নামের একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে রাখা হয়নি তাকে। পরে এই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের পরামর্শে নিয়ে যাওয়া হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৩ জুলাই সকাল
সাড়ে সাতটায় মারা যান নাসির।
মো. রফিকুল ইসলাম ও নাজমা বেগম দম্পতির পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্ণীপুরের রায়পুর উপজেলায়। পেটের দায়ে কাজ করতে ঢাকায় আসেন তারা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকার পর সবশেষ থিতু হয়েছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় ২ নম্বর গলিতে। তাদের যৌথ পরিবারের মধ্যে চার ভাই, পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবার বড় মো. নাসির হোসেন (৩৯)। বড় ভাই নাসিরকে বাকি রেখে ছোট দুই ভাই ও তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। এ ছাড়া ছোট এক ভাই ও দুই বোন এখন পড়াশোনা করছেন।
নাসিরের মা নাজমা বেগম বলেন, 'আগের দিন মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন নাসির। পরদিন দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। বেলা ১১টার দিকে তাড়াহুড়া করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। নাশতা খাওয়ার জন্য পেছন থেকে ডাকাডাকি করেছি। কিন্তু শোনেনি। ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে বাসায় আবার ফিরে আসে। ওকে দুইটা আটার রুটি দিয়েছি। নাসির চিনি দিয়ে মাখিয়ে খেয়েছে। এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাইরে লোকজন চিৎকার করে ডাকাডাকি করছে আর বলছিল, নাসির গুলি খাইছে।'
নাসিরের ছোট ভাই জিলানী ইসলাম বলেন, 'ভাইয়ের মাথায় তিনটা গুলি লাগে। তার মধ্যে একটা চিপে আর দুইটা কপালে। ভাই গুলি খেয়ে পড়ে যায়। কিন্তু জ্ঞান ছিল। রক্তপাত ঠেকাতে কেউ একজন পরনের শার্টটি খুলে তার মাথায় পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন। গুলি লাগার পার সেখান থেকে উঠে বাসার কাছের একটি দোকানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি বাসা থেকে নেমে দেখি, তার মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরছে। কোথায় গুলি লেগেছে- জানতে চাইলে ভাই বলেন, মাথায়। এটাই ছিল ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা। ভাইয়ের যেদিন গুলি লাগে সেদিন তার সঙ্গে চারজন ছিল, সবাই স্পট ডেড হয়েছে। এটা পরিকল্পিত হত্যা। তারা আগে থেকেই টার্গেট করে সবাইকে হত্যা করে।
তিনি বলেন, গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে মাতুয়াইলে এসএমসি নামের একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে রাখা হয়নি তাকে। পরে এই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের পরামর্শে নিয়ে যাওয়া হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের গেইটে বলে দেওয়া হয় এই রোগী ভর্তি করা যাবে না। তারপর জোড়াজুড়ি করে এক লোককে ৪ হাজার টাকা দিয়ে সেখানে ভর্তি করাই। সেখানকার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করাতে আরও ৪ হাজার টাকা দিতে হয়। আইসিইউতে থাকাকালীন প্রতিদিন গড়ে ১২-১৩ হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনে দিতে হতো। সেখানে তিন দিন আইসিইউ ও লাইফ সাপোর্টে থাকার পার ২৩ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টায় মারা যায়। সেখান থেকে ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। বিকাল ৪টায় লাশ দেওয়া হয়। লাশ আনতে মর্গে ৮ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। টাকা না দিলে লাশ পাইতে আরও অনেক সময় লাগত। এমনকি থানা থেকে বলে দেওয়া হলো অল্প সময়ের মধ্যে দাফন করতে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিতে দেয়নি লাশ। আমরা চেয়েছিলাম ভাইয়ের লাশ গ্রামের বড়িতে নিয়ে যাব।
নাসিরের অন্য আরেক ভাই আল আমিন বলেন, মাতুয়াইল কবরস্থানে মরদেহ সন্ধ্যায় নিয়ে গেলে সেখানে কবর দিতে দিবে না জানিয়ে দেওয়া হয়। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুমতি ছাড়া গুলিবিদ্ধ লাশ দাফন করা যাবে না। ওই ব্যক্তিকে ফোনে পেতে পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরে সন্ধ্যা সাতটার দিকে তারা লাশ দাফন করতে পারেন।
জিলানী বলেন, হাসপাতালে, মর্গে, এমনকি কবরস্থানে গিয়েও হয়রানির শিকার হয়েছি। বাসায় কুলখানির আয়োজন করতে পারিনি। ভয়ে মসজিদ থেকে কোনো হুজুর আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভয় এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকায় নূরপুর অনামিকা টেইলার্সে কাজ করতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত মো. নাসির উদ্দিন। আন্দোলনের সময় টেইলার্সের দোকান বন্ধ থাকায় কোনো কাজ ছিল না। সে সময় দোকানে আসা-যাওয়া করতেন। এর ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সময় দিতেন। আন্দোলনকারীদের তিনি বাসা থেকে ঠান্ডা পানি ও সরবত এনে খাওয়াইতেন। এলাকায় রান্না করে খিচুড়ি নিয়ে আন্দোলনকারীদের খাওয়াইতেন। অনামিকা টেইলার্সের মালিক আল আমিন বলেন, শান্ত স্বভাবের নাসির আন্দোলনকে ঘিরে যে এতটা সক্রিয় হবেন, তা কখনো ভাবেননি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা তার খোঁজখবর নিয়েছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত মো. নাসির হোসেনের বাবা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, নাসির যখন হামপাতালে ছিল, তার সঙ্গে জিনানী ও আল আমিন সব সময় ছিল। চিকিৎসায় কত টাকা খরচ হয়েছে তা তারাই বলতে পারবে। আমাদের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা দিয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো টাকা পাইনি।