অসময়ের বন্যা, বৃষ্টি,গরমে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে
প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের তাপমাত্রা আগে অনুকূল ছিল। আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছয়টি ঋতু ছিল। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত, বন্যা, তাপমাত্রা সবকিছুতেই পরিবর্তন হচ্ছে। অসময় গরম, অতিবৃষ্টি, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, খরা, লবণাক্ত পানিতে জমি ডুবে যাওয়াসহ বহুবিধ সমস্যায় বাংলাদেশের কৃষি এখন চরম হুমকির সম্মুখীন। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন আচরণে উষ্ণতা বাড়ছে। মধ্য আশ্বিনে গা শিন শিন করার কথা (শীত শীত অনুভূতি) থাকলেও এখন অসহনীয় গরম পড়ছে। আবার অসময়ের বৃষ্টিতে ফসল ও মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ছয়টি ঋতু ভিন্ন আবহাওয়ার আমেজ, ফুল-ফসলের সম্ভার নিয়ে আসে বাংলাদেশে। সবুজ, শ্যামল শস্যলতার সৌন্দর্যে দেশের প্রকৃতি হয়ে ওঠে অপরূপা। নতুন নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে একের পর এক আসে ছয়টি ঋতু। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত, হেমন্ত ও বসন্ত- প্রতিটি ঋতুর আলাদা বৈচিত্র্য আনন্দিত ও পরিপূর্ণ করত এ দেশের মানুষকে। ঋতুচক্রে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল ও ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। জলবায়ুর প্রভাবে প্রকৃতি তার ব্যাকরণ ভুলে যাচ্ছে। অসম আসে বর্ষা ও বন্যা। পুড়ে ফসলের মাঠ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে অসহনীয় গরমে দিশেহারা হয় মানুষ।
বাংলাদেশে বছরের এখন প্রায় ১০ মাস গরম থাকে। শীতের দুই মাসেও কোনো কোনো বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে। অসময়ে খরা আর বৃষ্টি প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। খরা বাংলাদেশের একটি প্রচলিত দুর্যোগ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তা নতুনরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। প্রতিবছর ৩০-৪০ হেক্টর ফসলি জমি বিভিন্ন মাত্রায় খরায় আক্রান্ত হয়। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা অযাচিতভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানাবিধ দুর্যোগের শিকার। বৈশ্বিক জলবায়ু
পরিবর্তনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের হার মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশের কম। আর উন্নত দেশগুলোতে গড় কার্বন নিঃসরণের হার ৬ টনের বেশি। কোনো রকম দূষণ না ঘটিয়েও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নিষ্পাপ শিকার।
পার্বত্য জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অধিক তাপে সেখানকার মাটির বুনন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এতে বর্ষায় বৃষ্টি বেড়ে সেখানে পাহাড়ধস বাড়ছে। বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কমছে। আবার বর্ষার আগে তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ।
জলবায়ু পরিবর্তন জীবন ও অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। জলবায়ুর প্রভাব এখন ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। চরম তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও খরা, অধিকতর তীব্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদীভাঙন, সাগরে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নৈতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় বাস্তুচু্যত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. অধ্যাপক শমসের আলম বলেন. শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন আচরণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোর শিল্পকারখানা ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যাপক নির্গমন ঘটছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়ছে জলবায়ুর অস্বাভাবিক আচরণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এসব কিছু ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়ী নয়। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত বিশ্ব।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক আন্তঃসরকার সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁতে চলেছে। তাবৎ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে ১৯৩টি দেশ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর অনিহায় তা বাস্তবায়ন হয়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইকবাল কবীর বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণের খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। উপকূলের মানুষকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলস পানি কিনে আনতে হয়। উপকূলীয় এলাকায় এক কলস পানির দাম ৫০-৮০ টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায়- এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়। দেশের উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলেও সুপেয় খাবার পানি এখন দুষ্প্রাপ্য। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের গবেষণায় বলা হয়েছে, পানির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে সুপেয় পানি পাচ্ছেন না প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে সুপেয় পানি সুবিধার অভাবে। দেশের উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওড়াঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা-বাগান ও দুর্গম এলাকায় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে।
আইপিসিসি'র চতুর্থ রিপোর্টে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বের পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন-কার্বন নির্গমন এবং তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী। বিশ্বে বাতাসে যত কার্বন ডাই অক্সাইড মিশছে, এর অধিকাংশই আসছে মাত্র চারটি শিল্পোন্নত দেশ থেকে। এগুলো হচ্ছে- চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। সঙ্গে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন আচরণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। বরফ গলে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ সবকিছু ঘটছে। পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট হাসান করিম বলেন, সারা বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি এবং এর প্রভাবের মধ্যে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবেই এর জন্য দায়ী উন্নত বিশ্ব। কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে চীন এবং এটি দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কার্বন নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। এরপর রয়েছে যথাক্রমে- ভারত, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, কানাডা ও ইন্দোনেশিয়া। আর সম্মিলিতভাবে ইইউ দেশগুলো কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণে ভারতের ওপর অবস্থান করছে।