বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

এক বুলেটে তছনছ সুখের সংসার

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

পাঠান সোহাগ
মিষ্টি আক্তার ও আব্দুর রহমান জিসান দম্পতি -ফাইল ফটো
'এক বুলেটে তছনছ হয়ে গেল আমাদের সুখের সংসার। চোখে গুলি লাগায় ছেলে মারা যাওয়ার ঠিক ৯ দিন পর ওর বউটা আত্মহত্যা করে। এখন আমি কিসের আশায় বাঁচব। আমার বাঁচা মরা তো একই কথা।' কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আব্দুর রহমান জিসানের মা জেসমিন আক্তার। প্রবাসী বাবুল সরদার ও জেসমিন আক্তার দম্পতির এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আব্দুর রহমান জিসান ছিলেন বড়। যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার ২ নম্বর গলির মতিউর রহমান মেয়ে মিষ্টি আক্তারকে ভালোবাসে বিয়েও করেন ১৪ মাস আগে। বিয়ের পর স্ত্রী মিষ্টি ও মাকে নিয়ে একই এলাকার গ্যাস রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। সুখেই চলছিল তাদের সংসার। জিসান কাজ করতেন পানি সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সময় ২০ জুলাই শনিবার যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার ২ নম্বর গলিতে দোকানে দোকানে পানি সরবরাহ করছিলেন। সেদিন থেমে থেমে গোলাগুলি চলছিল ওই এলাকায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে দোকানে পানি দেওয়ার সময় একটি গুলি বাম চোখে লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিসানের মা জেসমিন আক্তার বলেন, 'ছেলে ২ নম্বর গলিতে শ্বশুরবাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হন। গোলাগুলির সময় আতঙ্কে গলির মধ্যে বের হলে ও এক চোখে গুলি এসে লাগে। গুলি লাগার আগেও দোকানে দোকানে পানি দিয়েছে। সেখানকার লোকজন বলেছে, গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে বাবা বাবা বলে পড়ে যায় জিসান। পরে আশপাশের পরিচিত লোকজন ওকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখান থেকে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃতু্য হয়।' জিসানের শ্বশুর বাড়ির একাধিক ভাড়াটিয়া বলেছেন, সেদিন গুলাগুলির সময় জিসানের শ্বশুরসহ অনেকে ওপর থেকে জিসানকে ডেকেছে, এই গলিতে তখন লোক ভরা ছিল। এর কিছুক্ষণ পর জিসান গুলিবিদ্ধ হন। জিসানের মা জেসসিন বেগম বলেন, '২০ জুলাই শনিবার বিকালে গুলিবিদ্ধ হলো জিসান। রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি, ছেলে মারা গেছে। ২১ তারিখ রাত ১০টায় মর্গ থেকে ছেলের লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে দিন ২২ তারিখ ছেলের বাবা বিদেশ থেকে আসার পর বাদ আসর জানাজার নামাজ শেষে মাতুয়াইল কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর ঠিক ৯ দিন পর ২৯ জুলাই স্বামী শোকে জিসানের স্ত্রী মিষ্টি আত্মহত্যা করে মারা যায়। প্রথম ছেলেকে এবং এরপর ছেলের বউকে হারালাম। এখন আমারও মরার মতো বেঁচে আছি।' তিনি আরও বলেন, 'জিসান প্রেম করে বিয়ে করেছে। আমরা রাজি ছিলাম না। অল্প বয়সে বিয়ে করবে, যাদি না মানি, তাহলে তখনো আত্মহত্যার একটা ভয় ছিল। সেই ভয় এই সত্যি হলো। আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না।' জিসানের নানি অরুনা বেগম প্রতিদিন নাতির ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে কান্নাকাটি করেন। তিনি বলেন, 'ছোটবেলা জিসান এত দুষ্ট ছিল, এত কষ্ট করছি, স্কুলে পাঠাতে পারিনি। একটা চাকরি করত, বিয়ে করেছিল, বউ খুব সুন্দর ছিল। আমরা কাউকে বাঁচাতে পারলাম না।' তিনি আরও বলেন, 'জিসান আমার জন্য পান-সুপারি নিয়ে আসত, মাঝে মধ্যে ৫০, ১০০ টাকা দিত। এখন কে আমার জন্য পান-সুপারি আনব।' জিসানের বাবা বাবুল সরদার দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্রমিকের কাজ করতেন। ছেলের মুখটা শেষবারের মতো দেখার জন্য একরাত এক দিন জিসানের লাশ ফ্রিজিং গাড়িতে রাখা হয়েছিল। মৃতু্যর দুই দিন পর দেশে ফিরে ছেলেকে একাকার শেষ দেখা দেখে দাফন করেন। জিসানের বাবা বাবুল সরদার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার ভয়ে ছেলেকে মোটর সাইকেল কিনে দেননি। সেই অকাল মৃতু্য হলো ছেলের। বউ মা পুরো ভেঙে পড়েছিল। জিসানের প্যান্ট-শার্ট নিয়ে বসে থাকত। শোকে স্ত্রী মিষ্টি আত্মহত্যা করে। একটি সুখের সংসার এক সপ্তাহে মধ্যে তছনছ হয়ে গেল। জিসানের মা জেসমিন আক্তার বলেন, 'এখনো আমরা কারও কাছ থেকে কোনো অনুদান পায়নি। কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। শুনছি, এই এলাকার অনেকেই অনেক টাকা পেয়েছে। তবে আমরা পাব কিনা, সেটা বলতে পারছি না।'