শিল্পাঞ্চলে ফিরেছে কর্মচাঞ্চল্য

আশুলিয়ায় আর্থিক সংকটে বন্ধ ১৯ কারখানা

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
রাজধানীর অদূরে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের অধিকাংশ শিল্পকারখানায় ফের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে ২০ দিনের বেশি সময় ধরে চলা শ্রমিক অসন্তোষ কাটিয়ে ফের কর্মচাঞ্চল্য ফিরল শিল্পাঞ্চলগুলোতে। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী মাসিক হাজিরা বোনাস, টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতা বৃদ্ধি, নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নসহ ১৮টি দফা বাস্তবায়নে মালিকপক্ষের সম্মতির পর বুধবার কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এদিন সকাল থেকেই কারখানায় শান্তিপূর্ণভাবে কাজ যোগ দেন শ্রমিকরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আর্থিক সংকট ও বেতনসংক্রান্ত জটিলতাসহ কিছু সমস্যা থাকায় আশুলিয়ায় ১৯ কারখানা বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এদিকে, ঝুট ব্যবসার দখল নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদল ও কৃষকদলের কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, 'বুধবার সকাল থেকে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন। কোথাও কোনো ঝামেলার খবর পাওয়া যায়নি। তবে গত কয়েক দিনের পরিস্থিতির কারণে গাজীপুরে বন্ধ হওয়া কারখানাগুলো আজও খোলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দু-একদিনের মধ্যে এসব কারখানাও খোলা হবে।' গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার এম এম নিটওয়্যার কারখানার শ্রমিক সোলাইমান হোসেন বলেন, 'আমরা অযথা কোনো ঝামেলা চাই না। সারা মাস কাজ করে যখন বেতন পাই না, হাজিরা-বোনাস পাই না, তখন বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়।' গাজীপুরের স্টাইলিশ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'গার্মেন্টস শিল্প খুবই টাইট শিডিউলে চলে। আমরা নিজস্ব ব্যবস্থায় নিরাপত্তা জোরদার করেছি। বহিরাগতরা কারখানায় হামলা করছে। পোশাকশিল্প রক্ষা করতে অন্তর্র্বর্তী সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠিন হতে হবে। দেশি-বিদেশি নানা চক্র এই শিল্প খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। শিল্পকে বাঁচাতে না পারলে আমাদের দেশও পিছিয়ে যাবে।' আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ ও শ্রমিক নেতারা জানান, সাভার ও আশুলিয়ায় কয়েকটি কারখানায় আর্থিক সংকটের কারণে বেতনসংক্রান্ত জটিলতাসহ কিছু সমস্যা থাকায় ১৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ ছুটি রয়েছে ৫টি কারখানায় এবং শ্রম আইন-২০০৬-এর ১৩(১) ধারায় ১৪টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা, তবে কিছু খাদ্য প্রস্তুত, চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতসহ অন্যান্য পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন কারখানার সামনে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, 'শ্রমিকদের মাসিক হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতা বৃদ্ধি, নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নসহ ১৮টি দাবি বাস্তবায়নে মালিকপক্ষের সম্মতির পর শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে দাবিগুলো মানা বা বাস্তবায়নের তথ্যটি অনেক কারখানার শ্রমিকরা মালিকপক্ষের কাছ থেকে শুনতে চাইছেন। যেসব কারখানা বন্ধ বা কারখানায় শ্রমিকদের নিয়ে মালিকপক্ষের শঙ্কা রয়েছে, সেসব কারখানার মালিকপক্ষ, সরকারের প্রতিনিধি ও শ্রমিকপক্ষ মিলে আলোচনা করলে সমাধান হয়ে যাবে।' যুবদল-কৃষকদলের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, শ্রীপুরে পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুবদল ও কৃষকদলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। বুধবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত শ্রীপুর পৌর এলাকার ২নং সিএন্ডবি নামক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পৌর এলাকার সিএন্ডবির এসকিউ সেলসিয়াস সোয়েটার কারখানার ঝুট ব্যবসার কোম্পানির ওয়ার্ক অর্ডার পান যুবদল নেতা এসএম পলাশের চঞ্চল এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বুধবার সকালে তার লোকজন কারখানায় ঝুট বের করতে গেলে কৃষকদলের কয়েকজন নেতাকর্মী তাদের বাধা দেন। একপর্যায়ে কৃষকদল ও যুবদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় একটি হায়েস ও তিনটি প্রাইভেটকারসহ বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলের পাশেই কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকজন দৌড়াদৌড়ি করেন। এতে আহত হন উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন। এ ঘটনার ভিডিও ধারণের সময় মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে লাঞ্ছিত করা হয় বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীকে। বেসরকারি টেলিভিশন যমুনা টিভির জেলা প্রতিনিধি হোসাইন আলী বাবুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হুমকি দেন কৃষকদলের লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে সংবাদকর্মীরা নিরাপদ স্থানে আসেন। এ বিষয়ে যুবদল নেতা এস এম পলাশ বলেন, 'গত ৫দিন আগে আমি ওই কারখানায় ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছি। আজকে ঝুট বের করার সময় কৃষকদল নেতা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে আমার লোকজনের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। আমাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।' এ ঘটনায় জড়িত কেউ নিজের কর্মী নয় জানিয়ে গাজীপুর জেলা কৃষকদলের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'শুনেছি একাধিক ব্যক্তি ওই কারখানায় ওয়ার্ক অর্ডারের জন্য দরপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু সেখানে আমার নিজের নামে অথবা আত্মীয়-স্বজনের নামে কোনো দরপত্র জমা দেওয়া হয়নি। আমাকে রাজনৈতিক হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য শুধুমাত্র আমার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।' এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন বলেন, ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে কিছু সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে রাখে তারা। খবর পেয়ে থানা পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। এ ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিক বিক্ষোভ অন্যদিকে, এক মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে নগরের ছয়দানা হাজীপুর পুকুর এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ফুল এভার বিডি লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। বুধবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়েন যাত্রীরা। গাজীপুর শিল্প পুলিশ ও কারখানার শ্রমিক সূত্রে জানা যায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর এক মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন তারা। কারখানা কর্তৃপক্ষ বেতন পরিশোধ না করে ১২ সেপ্টেম্বর কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে। গত সোমবার গাজীপুরে প্রায় সব কারখানার শ্রমিকরা বেতন-ভাতা পেলেও এ কারখানার শ্রমিকরা পাননি। তাই এদিন শ্রমিকরা ফের বিক্ষোভ করেন। কারখানার শ্রমিক হাজেরা বেগম জানান, আগস্ট মাসের বেতন হয়নি, আবার চলতি মাসের ২৫ তারিখ হয়ে গেছে। বেতন না পেয়ে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের। দোকানে বাকি খেয়েছেন, সেই টাকাও দিতে পারছেন না। ঘরভাড়াও দিতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে বেতনের দাবিতে সড়কে নেমে এসেছেন।