'মা গুলিবিদ্ধ এক বন্ধুকে হাসপাতালে দিয়ে আসছি। দেরি করব না। নামাজের সালাম ফিরিয়ে মা দেখে ছেলে নেই। বাসা থেকে গুলিবিদ্ধ বন্ধুর ক্ষত জায়গা বেঁধে দেওয়ার জন্য কাপড় নিয়ে দ্রম্নত বেরিয়ে যায়। ছেলে আর আসে না। সন্ধ্যায় ছেলের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবর পাই। গুলিতে ছেলের মগজ বেরিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে ছিল। সেই দৃশ্য মনে হলে আঁতকে উঠি।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মাহমুদুর রহমান সৈকতের (২০) শহীদ হওয়ার ঘটনার এমন হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন তার বাবা মাহাবুবের রহমান (৬৫)। একমাত্র ছেলের মৃতু্যর কথা বলতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
মঙ্গলবার ঢাকার মোহাম্মদপুর থানাধীন নূরজাহান রোডের দই ঘর নামের সৈকতদের নিজস্ব দোকানে বসেই কথা হচ্ছিল সৈকতের বাবার সঙ্গে।
ছোট্ট দোকান। দোকানের জিনিসপত্র সব এলোমেলো। একটি বড় ফ্রিজ বিক্রির বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ল। দোকানের ঠিক সামনের দেয়ালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ সৈকতের বিষয়টি লেখা রয়েছে। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ
একজনকে কোলে করে আরেকজন নিয়ে যাচ্ছে। দোকানের যে চেয়ারে সৈকতের বাবা বসে থাকেন, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় দেয়ালে আঁকা এই দৃশ্যটি। সেখানে লেখা, 'ছাত্র আন্দোলনে বীর শহীদ সৈকত, আমরা তোমাকে ভুলব না'।
সৈকতের বাবা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সেই দেয়ালের দিকে। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে দোকানের চেয়ারে বসেছিলেন। সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় জানালাম। এরপর এ কথা সে কথার ছলে সৈকতের প্রসঙ্গে জানতে চাই। এই তিনি যেন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। হু হু করে কেঁদে ফেললেন। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর জীবনের নানা ইতিহাস বলতে শুরু করলেন।
তিনি বলেন, 'আমাদের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার ১ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন মুসাপুর গ্রামে। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় আসি। বোনের সঙ্গে বসবাস শুরু করি ঢাকার শান্তিনগরের চামেলীবাগ এলাকায়। ডিপেস্নামা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে সৌদি আরবে চলে যাই। ১০ বছর সেখানে চাকরি করে দেশে আসি। দেশে ফিরে বিয়ে করি আফরোজা রহমানকে। স্ত্রীর বয়স এখন ৫০ বছরের কাছাকাছি। বিয়ের পর সংসার শুরু করি ঢাকার মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডে। বর্তমানে এখানকার ডি বস্নকের ৩৮ নম্বর বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি।'
তিনি বলেন, আমাদের সংসারে তিন সন্তান। সবার বড় মেয়ে শাহরিনা আফরোজ সুপ্তি (২৬)। তাকে বিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় মেয়ে সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী (২৩)। অবিবাহিত। ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে অবস্থিত বেসরকারি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অর্নাস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আর সবার ছোট ও একমাত্র ছেলে ছিল সৈকত। সে সরকারি মোহাম্মদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করে। ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত সরকারি তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তির সুযোগ পায়। ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরুর আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
তিনি আফসোস করে বলেন, বিদেশে থাকার সময় অনেক টাকা রোজগার করলেও তা ধরে রাখতি পারিনি। আবেগে আত্মীয়-স্বজনদের ও পরিচিতদের চাওয়া মাত্রই ধার দিয়েছি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেইসব টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন তারা। অদ্যাবধি সেই টাকা আর ফেরত পাইনি। এমন পরিস্থিতিতে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরে অনেক কষ্টে ১৫ লাখ টাকা ঋণ করে 'দই ঘর' নামে এই দোকানটি চালু করি। তা প্রায় ৭ বছর হলো। দোকানের ভাড়া মাসিক ২০ হাজার টাকা। এক সময় দোকানটিতে শুধু দই বিক্রি করতাম। গত এক বছর ধরে ব্যবসা চরম খারাপ। শুধু দই বিক্রি করে আর পোষাচ্ছিল না। তাই দোকানে দইয়ের পাশাপাশি বিস্কুট, চিপস, পানি, কোমল পানীয়সহ নানা হালকা মুখরোচক খাবার রাখি। যাতে কিছুটা টাকা আসে।
তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় আমিই দোকানে বসতাম। তবে ছেলেও মাঝে মধ্যে দোকানে বসত। আমি বাড়ি থাকায় ছেলে দোকানটি চালাচ্ছিল। কোনো দিন দোকান থেকে না বলে একটি টাকাও নিত না। এছাড়া ছেলে দুটি টিউশনি করত। মাসে ৮ হাজার টাকা পেত। টাকা পেয়ে অন্তত ৫ হাজার টাকা সংসার খরচের জন্য দিত। জীবনে কোনো দিন খারাপ করেছে বলে আমার জানা নেই। কোনো ধরনের বাজে অভ্যাস ছিল না।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'ওইদিন ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। আমি পারিবারিক কাজে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। বাড়ির পুকুরের পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছিলাম। পুরো দেশে ছাত্রদের আন্দোলন চলছিল। এজন্য আমি ঘন ঘন ছেলের মোবাইল ফোনে কল করতাম। তার অবস্থান জানার চেষ্টা করতাম। সকাল থেকে নিয়ে দুপুর পর্যন্ত কথা হয়। গন্ডগোলের খবর পেয়ে আমি ছেলেকে দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যেতে বলি। ছেলে তাই করে। শুক্রবার তেমন কোনো আন্দোলন হবে না ভেবে, ছেলে দোকান খুলতে চাইলে আমি না করিনি। ভাবলাম, জুমার নামাজের পর তেমন কিছু হবে না। এরপর জুমার নামাজের পর যথারীতি দোকান খুলে। আসরের নামাজ পর্যন্ত দোকান খোলাই ছিল। তখন গন্ডগোল ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আমি ফোন দিয়ে দোকান বন্ধ করে ছেলেকে বাসায় থাকতে বলি। ছেলে তাই করে। ছেলে বাসায় আছে বলে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম।'
সৈকতের বাবা বলেন, 'সন্ধ্যার কিছুটা আগে আমার মোবাইলে ছেলের ফোন থেকে কল আসে। কল রিসিভ করে ছেলে মনে করেই কথা বলছিলাম। এ সময় ছেলের ফোনে অপরিচিত এক ব্যক্তি বলেন, আমি আপনার ছেলে না। হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনার ছেলে গুলিতে মারা গেছে। আপনি দ্রম্নত ঢাকার শেরেবাংলানগর এলাকায় অবস্থিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসুন। এমন কথা শোনার পর আমার আর হুঁশ নেই। আমি দ্রম্নত ঢাকায় থাকা সবাইকে ফোন করে সৈকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানাই। সৈকত যে মারা গেছে, সে খবরটি গোপন রাখি। কারণ এতে পরিবারের লোকজন ভেঙে পড়তে পারে।'
তিনি বলেন, আমি দ্রম্নত যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থাতেই ঢাকা যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি শুরু করি। সন্দ্বীপ একটি নির্জন জায়গা। সেখান থেকে সব সময় লঞ্চ বা ট্রলার পাওয়া যায় না। ওইদিন সাগর উত্তাল ছিল। অনেক কষ্টে একটি ট্রলার চট্টগ্রাম যাচ্ছে বলে খবর পাই। একজনের মাধ্যমে অনেক অনুরোধ করে ট্রলারটিকে ১০ মিনিট দেরিতে ছাড়তে রাজি করাতে সক্ষম হয়। দ্রম্নত ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। ঢাকায় যখন পৌঁছি তখন রাত দেড়টা বাজে। ততক্ষণে সৈকতের লাশ মোহাম্মদপুরের সলিমুলস্নাহ রোড জামে মসজিদের সামনে নেওয়া হয়েছে। জানাজা নামাজ শেষে জামে মসজিদ কবরস্থানেই সৈকতকে দাফন করা হয়। লাশের সঙ্গে সৈকতের ডেথ সার্টিফিকেট দেয় হাসপাতাল থেকে। তাতে লেখা রয়েছে, 'গান শট' অর্থাৎ 'গুলিতে মৃতু্য'।
তিনি স্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেন, আসরের নামাজের আজানের পর পরই সৈকত দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যায়। এ সময় সৈকতের মা আসরের নামাজ আদায় করছিল। সৈকত বাসায় যাওয়ার পর তার মোবাইল ফোন একটি কল আসে। ফোন রিসিভ করে সৈকত বলে, আমি আসছি। তখনও সৈকতের মা নামাজে ছিল। সৈকত মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা গুলিবিদ্ধ এক বন্ধুকে হাসপাতালে দিয়ে আসছি। এই বলে বাসা থেকে গুলিবিদ্ধ বন্ধুর ক্ষতস্থান বাঁধার জন্য একটি কাপড়ের টুকরো নিয়ে দ্রম্নত বেরিয়ে যায়। নামাজের সালাম ফিরিয়ে দেখে ছেলে নেই। চলে গেছে। এরপর নুরজাহান রোডের মাথায় সৈকত গুলিবিদ্ধ হয়।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে সৈকতের বাবা বলেন, পুলিশের এসআই শাহরিয়ার গুলিবিদ্ধ বন্ধুকে সহায়তা করতে যাওয়ায় সৈকতের ওপর চড়াও হয়। ওই পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি সৈকতের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই সৈকত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই আমার বাবা ছটফট করতে করতে মারা যায়। তার মুখে পানি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। গুলিতে মগজ বেরিয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ে। সেই দৃশ্য পরবর্তীতে আমি পেয়েছিলাম। আমার মোবাইল ফোন থেকে সেই দৃশ্য ডিলিট করে দিয়েছি। ওই দৃশ্যের কথা আমি আর মনে করতে পারি না। মনে করলে আমার বুক ভেঙে যায়। আমার একমাত্র সোনার ছেলেকে এভাবে স্বাধীন দেশের পুলিশ হত্যা করবে ভাবিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছে। সেই দৃশ্য দেখেছি। আর স্বাধীন দেশে বাঙালি হয়ে বাঙালিকে এভাবে হত্যার করার দৃশ্য দেখতে হবে বা শুনতে তা কোনোদিনই কল্পনাও করিনি।
তিনি বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে আমিও মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডের নাম বদলে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকত রোড নামকরণ করা হোক। আমার ছেলেকে সত্যিকারের শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। তবে আমি লাশ তুলে নতুন করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার পক্ষে নই। কোনোভাবেই আমি লাশ আর কবর থেকে তুলতে দিব না। এমনকি লাশের পোস্টমর্টেমও করতে দিব না। সত্যিকারের শহীদ হিসেবে ঘোষণা করার এবং বাস্তবায়ন করার অনেক পন্থা আছে। সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। শুধু দুই সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে ছেলে সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। এই পর্যন্তই। আর কেউ যোগাযোগ করেনি।
তিনি বলেন, ছেলে আমার মাথার উপর থাকে। দোকানের চেয়ারে বসতে পারি না। বসলেই দেয়ালে আঁকা ছবি চোখে পড়ে। আর তখন আমি স্বাভাবিক থাকতে পারি না। এজন্য ঠিক আমার চেয়ারের উপরে দেয়ালে ছেলের ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছি। যাতে মানুষ দেখতে পারে। আমি ইচ্ছা করেই ছেলের ছবির দিকে তাকাই না। এমনকি তাকাতেও পারি না বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন এই বয়স্ক বাবা।