বিশ্বনেতাদের ড. ইউনূস

নতুন বাংলাদেশ গড়তে সবার সহযোগিতা চাই

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে হিলটন হোটেলে মঙ্গলবার 'ক্লিনটন গেস্নাবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ' অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তার পাশে ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক (বাঁ থেকে) মাহফুজ আলম, সুচিস্মিতা তিথি ও নাইম আলী -পিআইডি
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যুবসমাজের জীবন উৎসর্গ ও অদম্য নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষে তারা জীবন দিয়েছে। তরুণদের এই স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। এটি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন।' জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির ৫০তম বছর উদ্‌?যাপন উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ; যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রমুখ। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আলোকচিত্রী ও লেখক শহিদুল আলম গণ-অভু্যত্থানের ঘটনা নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, তাদের আমরা হতাশ করতে চাই না।' প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার সরকার কাজ করছে বলে উলেস্নখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. ইউনূস বলেন, যুবসমাজের সামনে কোনো স্বপ্ন ছিল না। স্বৈরাচার তাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাই তারা স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে বুলেটের সামনে দাঁড়াতে পিছপা হয়নি। বাংলাদেশের তরুণরা যে সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছেন, তা অভিভূত করেছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে তারা পঙ্গুত্ব বরণ করতে পিছপা হয়নি। তরুণদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ গড়তে আমরা আপনাদের পাশে চাই।' হোয়াইট হাউসের বিবৃতি : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়, বৈঠকে বাইডেন বলেছেন, বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি নিয়ে মঙ্গলবারই হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানাতে গত মঙ্গলবার তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে উভয় নেতা যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্বের বিষয়টি উলেস্নখ করেন। আর এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে পারস্পরিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের মধ্যকার শক্তিশালী বন্ধন। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে আরও সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ২০ কোটি ডলার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় সরকারকে প্রায় ২০ কোটি ডলার অনুদান দেবে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ১২ কোটি ৯০ লাখ ডলার দেবে দেশটির উন্নয়ন সংস্থা ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)। আর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে মিলবে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এই ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। বাসস জানিয়েছে, মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়া ৬ লাখ ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার জরুরি প্রয়োজন মেটাতে এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশকে দেওয়া ২১০ কোটি ডলার রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর পস্নাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রম্নতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। ঐক্যমত হলেই নির্বাচন রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একমত হলেই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনের সময় ঠিক করার ক্ষেত্রে ভোটার তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমতে উপনীত হওয়া এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ বলা হবে।' মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। এ সময় রাষ্ট্র সংস্কারে আইএমএফ ইউনূসের সরকারের 'পাশে আছে' জানিয়ে জর্জিয়েভা জানিয়েছেন, এই কাজের জন্য আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় পাঠান হয়েছে। দলটি ঢাকা ঘুরে এসে আগামী মাসে আইএমএফ পরিচালনা পর্ষদের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। \হবৈঠকে ইউনূস বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারে উৎখাত নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। ইউনূস নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য গঠন করা ছয়টি কমিশনের কথা তুলে ধরেন। এসব উদ্যোগে সমর্থন জানিয়ে জর্জিয়েভা বলেন, 'আইএমএফ বাংলাদেশ সরকারের জন্য আর্থিক সহায়তা দ্রম্নততর করবে। আইএমএফ বোর্ড টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ঋণদান কর্মসূচি শুরু করতে পারে, অথবা এটি গত বছরের শুরুর দিকে চালু হওয়া বিদ্যমান সহায়তা কর্মসূচির অধীনে আরও ঋণ দিতে পারে।' ইতালি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনের সাইডলাইনে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানায়, মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ক্লিনটন গেস্নাবাল ইনিশিয়েটিভ ২০২৪-এর সভায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তৃতা করেন। ইউএনজিএ অধিবেশনের সাইডলাইনে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অধ্যাপক ইউনূস নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সাইডইভেন্টেও যোগ দেন। পরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন তিনি। এর আগে অধ্যাপক ইউনূস নিউইয়র্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধানের সঙ্গে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম।