'একটা তপ্ত বুলেট কেড়ে নিল আমার তরতাজা ছেলের প্রাণ। আমাকে চিরদিনের মতো নিঃস্ব করে দিল। এখন আর আমারে কেউ "মা" বলে ডাকে না। আমার জন্য কেউ ওষুধ এনে বলে না, মা এই নাও তোমার ওষুধ।' এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরিফ হোসেনের মা বৃদ্ধা সূর্যা বানু।
শনিরআখড়া মেইন রোডের ঢালে আরিফের ফুফুর বাসায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি জানান, ২০ জুলাই শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন আরিফ। ঘটনাস্থলেই মৃতু্যর পর অটোরিকশা দিয়ে লাশ নিয়ে আসে বাসায়। এলাকাবাসী পরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরের দিন রোববার রাত ১টার দিকে লাশ দাফন করা হয়।
আরিফের মা ও স্ত্রী সানিয়া আক্তার থাকতেন মাতুয়াইল কবরস্থানের পিছনে গোবিন্দপুরে (বাক্কার মোড়) এলাকায়। গত কয়েকদিন আগে দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে বাসার মালিক রুহুল আমিনের ১৬/২১৪ নম্বর বাসায় ভাড়া ঘরে পানি ওঠায় সেটাও ছাড়তে হয়।
আরিফের মা সূর্যা বানু বলেন, 'এখন আমাদের নিজস্ব কোনো ঠিকানা নাই। একেক দিন একেক জনের বাসায় অবস্থান করতে হচ্ছে। খাবারের জন্য মানুষের বাসায় গিয়ে হাত পাততে হয়। আমার পোলাডা রিকশা চালাইত। যা আয় রোজগার করতে পাইত, তা দিয়ে আমার চিকিৎসা আর তিন জনের সংসারের খরচ চলত।'
সূর্যা বানু বলেন, 'পটুয়াখালীর দশমিনা আমাদের বাড়ি। সেখানে কোনো জায়গা জমি নেই। ৩০ বছর আগে এই যাত্রাবাড়ী এলাকায় আসি। আরিফের বাবা সবুজ আলি রিকশা চালাইত, আমি ইট ভাঙ্গার কাজ করতাম। আমার স্বামী ১০ বছর আগে মারা গেছেন। আমি ইট ভেঙ্গে যা পাইতাম তা দিয়ে সংসার চলত। গত ৭-৮ বছর যাবৎ ইট ভাঙার তেমন কাজ নাই। কারণ মেশিন দিয়েই এখন ইট ভাঙায় সবাই।'
আরিফের মা সূর্যা বানু গত দুই তিন বছর খুবই অসুস্থ ছিলেন। আরিফের মৃতু্যর কয়েক দিন আগে ৬ মাস হাসপাতালে থেকে বাড়িতে এসেছেন। সে সময় আরিফ রিকশা চালিয়ে চিকিৎসা খরচ চালাত। তখন বাসার ভাড়াও দিতে পারেননি। বাসা ভাড়া ৭০ হাজার টাকা এখনও বাকি পড়ে আছে। তাদের এখন কোনো আয় রোজগার নেই।
আরিফের স্ত্রী সানিয়া আক্তার বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আরিফ নিহত হয় ২০ জুলাই শনিবার। এই মাসেই আমার বাচ্চা হওয়া তারিখ দিয়েছিল ছিল চিকিৎসকরা। আরিফের কবর দেওয়া হয় মাতুয়াইল কবরস্থানে। কবর দেওয়ার তিন দিন পরে সবার পরামর্শে আমি বাপের বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনা চলে যায়। সেখানে গিয়ে আমার আমার আত্মীয়-স্বজন সাহায্য তুলে টাকা জোগাড় করে আমাকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে ১৮ আগস্ট সিজারের মাধ্যমে একটা ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। সেখানে এক দেড় মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকার খরচ হয়। আমরা নিঃস্ব। আলস্নাহ ছাড়া আমাদের আর দেখার কেউ রইল না।'
ছেলে জন্মের পর সবাই ছেলের নাম রাখছে স্বাধীন। নতুন স্বাধীন দেশে আমার জন্ম নেওয়া ছেলে জন্মের পর বাবাকে পেল না। এই আক্ষেপ জানিয়ে সানিয়া আক্তার বলেন, 'এখন ছেলে কার পরিচয় নিয়ে বাঁচবে। ছেলের ভরণপোষণ কে দেবে। সেটা নিয়ে আমি খুবই সংশয়ে আছি।'
আরিফের স্ত্রী সানিয়া আক্তার আরও বলেন, 'আমাদের বিয়ে হয় পাঁচ বছর আগে। সন্তান হয় না, হয় না। আলস্নাহ যাও একটা সন্তান দিল কিন্তু সন্তানের বাবাকে কেড়ে নিল। আমি তো এটা চাইনি। আমি তো স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে চাইছিলাম। সেই সুখ আমার কপালে সইল না। ছেলের বাবা যাদের কারণে শহীদ হলো তাদের কেউ দেখতে আসে না। আমার কীভাবে চলছি। আমরা কি, আমার ছেলেকে নিয়ে দু'মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব।'
আরিফের মামাতো ভাই সাইফুল ইসলাম কাজ করেন শনিআখড়ার একটি কাপড়ের দোকানে। তিনি নিজ উদ্যোগে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে কিছু সাহায্য তুলেন। সে সময় কেউ ৫০, ১০০, ৫০০ টাকা করে দান করেছে। সে সময় ১৫ হাজারের মতো টাকা উঠছিল। সেই টাকা দিয়ে দাফনের কার্যক্রম শেষ করেন। আরিফের চিকিৎসা বাবদ কোনো টাকা খরচ হয় নি। হাসপাতাল থেকে লাশ আনার সময় মর্গে ৫-৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরপর কবর দিতে ৭-৮ হাজার টাকা লেগেছে। সরকারিভাবে কোনো অনুদান পায়নি আরিফের পরিবার। শুধুমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইমলামের ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে। সেই টাকা দিয়ে গত কয়েক মাসে যে ধারদেনা হয়েছিল সেটা পরিশোধ করেছে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আরিফ রিকশা চালাইত, প্রতিদিনের মতো সেদিনও রিকশা নিয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু তার আর বাড়ি ফেরা হলো না। আমরা শুনছি সে দিন সাড়ে ১২টার দিকে গুলি লাগে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আমরা সেখান থেকে (মর্গ) পরের দিন রাত দেড়টার সময় লাশ পাই।'
আরিফের মা সূর্যা বানু বলেন, 'আমরা এখনো সরকারিভাবে কোনো অনুদান পায়নি। শুধুমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইমলামের ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে গত কয়েক মাসে যে ধারদেনা হয়েছিল সেটা পরিশোধ করেছি। এখন আমাদের হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। আমরা ভবঘুরের মতো জীবন যাপন করছি।'