ফের শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল আশুলিয়া, বন্ধ ৫১ কারখানা
প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
নূ্যনতম বেতন ২৫ হাজার টাকায় উন্নীত করাসহ নানা দাবিতে সোমবার শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় ফের সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি পালন করছেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে আশুলিয়ায় ৫১ পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। তবে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এদিন দুপুর ১২টার দিকে শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম ৫১ কারখানা বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, শ্রমিক অসন্তোষের জেরে সোমবার অন্তত ৪৩টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে; আটটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি খাদ্য উৎপাদন কারখানার বিক্ষোভের সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ছয়জনকে আটক করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নরসিংহপুর এলাকায় জেনারেশন নেক্সট পোশাক কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক এক মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এর আগে, রোববার দুপুরের পর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হা-মীম, শারমিন, নাসা ও আল মুসলিম ডেকো গ্রম্নপের পোশাক কারখানাগুলোতে হামলা চালায়। এ সময় তারা কারখানার প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে অন্যান্য শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেন। এ পরিস্থিতে রোববার সন্ধ্যায় টঙ্গী আশুলিয়া সড়কের দুই পাশের প্রায় ৪৩ পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে প্রধান গেটে নোটিশ দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। সোমবার সকালে ৮ পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলেও দুপুরের পর কারখানাগুলোতে শ্রমিক
বিক্ষোভের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
হা-মীম গ্রম্নপের একটি প্রতিষ্ঠানের গেটে দেওয়া নোটিশে দেখা যায়, 'দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়ার লিমিটেড, অ্যাপারেল গ্যালারি লিমিটেড, রিফাত গার্মেন্টস লিমিটেড, এক্সপ্রেস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড, আর্টিস্টিক ডিজাইন লিমিটেড, নেক্সট কালেকশন লিমিটেডের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের জানানো যাচ্ছে যে, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বর্তমান সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১৩ (১) অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইং তারিখ রোজ সোমবার হইতে উলেস্নখিত কারখানাসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।'
'পরবর্তীতে আঞ্চলিক পরিবেশ নিরাপদ হলে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নোটিশের মাধ্যমে কারখানা খোলার তারিখ জানিয়ে দেওয়া হইবে। কারখানায় নিরাপত্তা বিভাগ অত্র নোটিশের আওতামুক্ত থাকবে বলে ওই নোটিশে বলা হয়েছে।'
অনন্ত গ্রম্নপের একটি কারখানার গেটেও বন্ধের নোটিশ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনকারী একজন শ্রমিক বলেন, 'কয়েকটি কারখানার শ্রমিক বিভিন্ন দাবি করলেও তারা উৎপাদন চালু রেখেছেন। অন্য কারখানার শ্রমিকরা চালু কারখানায় এসে ঝামেলা করলেও সব শ্রমিক কাজ করেছেন। তার পরেও কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধ করে রেখেছেন।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন শ্রমিক বলেন, 'গত মাসসহ চলতি মাসের বেতন পরিশোধ না করে কারখানা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা বাসা ভাড়া ও দোকানের বাকি পরিশোধ করতে পারছেন না। সারা মাস কাজ করে বাড়িওয়ালা ও দোকান মালিকের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হচ্ছে। এর আগে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেতন পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা করেনি মালিকপক্ষ। তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছেন।'
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বলেন, 'আমরা বিভিন্ন দাবিতে কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েকবার বসেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবিগুলো মেনে নেয়নি। আমাদের পোশাক খাতে শ্রমিকদের নূ্যনতম বেতন ২৫ হাজার টাকা করার জন্য কয়েকবার আন্দোলন করা হয়েছে। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে না নিয়ে তালবাহানা করছে।'
শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, 'সকালে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেন। পরে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছে। তবে শিল্পাঞ্চলে ৪৩ পোশাক কারখানা ১৩ (১) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও ৮ পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে এবং সেনাবাহিনী টহল অব্যাহত রেখেছে।'
এদিকে দুপুরে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকে জানানো হয়, সাভারের আশুলিয়ায় ২৭২টি পোশাক কারখানার মধ্যে নাসা, নিওএইজ, অনন্ত, হা-মীম, এনভয়, দেবোনিয়ার গ্রম্নপের কারখানাসহ মোট ২৭টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সবেতন ছুটি কিংবা শ্রমিকেরা কারখানায় উপস্থিত হয়ে কাজ বন্ধ রেখেছেন অথবা শ্রমিকেরা চলে গেছেন- এমন কারখানার সংখ্যা ১২। আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করেছে ২৬৭টি এবং বেতন পরিশোধ করেনি ৫টি কারখানার মালিক।
গাজীপুরে আটক ৬
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার কালিয়াকৈরে একটি খাদ্য উৎপাদন কারখানার বিক্ষোভের সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ছয়জনকে আটক করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা হলেন- খোকন মিয়া, সোহাগ মিয়া, নাজমুল মিয়া, উজ্জ্বল হোসেন, শাকিল আহাম্মেদ ও মোবারক হোসেন। সোমবার সকালে উপজেলার মৌচাক এলাকায় 'কোকোলা ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড কারখানা' এলাকায় বিক্ষোভের সময় তাদের আটক করা হয় বলে গাজীপুর শিল্প পুলিশের (জোন-২) পরিদর্শক নিতাই চন্দ্র সরকার জানান। তবে তারা শ্রমিক না-কি বহিরাগত সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাতে পারেনি শিল্প পুলিশ। উপজেলার পৃথক এলাকায় তিনটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে রোববার সকালে কোকোলা ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এরপরও সোমবার সকালে শ্রমিকরা কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এরপর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের একপর্যায়ে কিছু শ্রমিক কারখানার ভেতরে ঢুকে ভাঙচুরের চেষ্টা চালান।
খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, থানা-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের ধাওয়া দেন। এ সময় কারখানার ভেতরে অবৈধভাবে প্রবেশ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ছয়জনকে আটক করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা হ্যান্ডমাইকে শ্রমিকদের কারখানা এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
কারখানার শ্রমিক আব্বাস উদ্দিন জানান, তাদের কারখানায় পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তাদের সর্বনিম্ন বেতন দেওয়া হয় ৮ হাজার টাকা। এই টাকায় ঘর ভাড়া আর খাওয়া হয় না। তাই অনেকদিন ধরেই তারা সর্বনিম্ন বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে মালিকপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এদিকে কয়েকদিন শ্রমিক আন্দোলনের কারণে কালিয়াকৈরের সফিপুর বাজার এলাকার মাহমুদ ডেনিম, বক্তারপুর এলাকার ইকু নিটসহ (সামহার) তিনটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের (জোন-২) পরিদর্শক নিতাই চন্দ্র সরকার বলেন, 'কারখানা বন্ধ ঘোষণার পরও কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক কারখানার ভেতরে জোর করে প্রবেশ করছিলেন। আটক শ্রমিকদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শ্রমিকেরা কিছু সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।'
১২ দফা দাবিতে বিক্ষোভ
এদিকে, হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ ১২ দফা দাবিতে সদর উপজেলার বাঘেরবাজার এলাকায় 'গোল্ডেন রিফিট গার্মেন্টস লিমিটেড' নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন। সোমবার সকাল ৮টা থেকে ওই কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন।
কারখানার শ্রমিকেরা বলেন, তারা ১২ দফা দাবিতে কারখানার ভেতরে অবস্থান নেন। কর্তৃপক্ষ এসব দাবির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এরপর তারা মহাসড়ক অবরোধ করেন। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল, নাইট বিলসহ আটটি দাবি মেনে নেয়। তবে ১২টি দফা মেনে নেওয়ার দাবি জানিয়ে তারা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন।
এদিকে শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে এদিন সকাল থেকেই মহাসড়কের ওই অংশের আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন মানুষ।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের বাঘের বাজার জোনের পরিদর্শক সুমন মিয়া বলেন, 'সকাল থেকে শ্রমিকরা মহাসড়কে আন্দোলন করেছেন। এতে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে মাওনা পর্যন্ত তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।'