চট্টগ্রামে সাবেক তিন মন্ত্রীসহ ২২৫ জনের নামে মামলা
প্রথমবার ট্রাইবু্যনালে হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ
প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। সোমবার ব্যবসায়ী এনামুল কবির ২০১৮ সালে তাকে ডিবি পুলিশ দিয়ে গুম করে রাখার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দেন। আর সাভারে শিক্ষার্থী শাইখ আসাহাবউল ইয়ামিনকে গুলি করে সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনায়ও ট্রাইবু্যনালে অভিযোগ করেছেন তার মামা। এতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরসহ ৭৮ জনকে। এ ছাড়া ঢাকার কাফরুলে ফজলু নামে এক গার্মেন্টকর্মী হত্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতিসহ ৭১ জনের নামে মামলা হয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রামে চাকরিজীবী আলম হত্যা মামলায় সাবেক তিন মন্ত্রী ও পাঁচ এমপিসহ ২২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের
মুরাদপুরে শিক্ষার্থী সুজনের ডান পায়ে গুলি করার ঘটনায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলসহ ১৭৭ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রোববার পর্যন্ত কমপক্ষে ২৯টি পৃথক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগের সংখ্যাও বাড়ছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচু্যত হন শেখ হাসিনা। এরপর তিনি বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের ক্ষমতার অবসান ঘটে।
হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যত গুম হয়েছে, সব ঘটনার তদন্ত চাওয়া হয়েছে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে এই অভিযোগ দাখিল করা হয়।
২০১৮ সালে ১০ দিন গুম রাখার বিষয় উলেস্নখ করে ট্রাইবু্যনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এই অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী এনামুল কবির।
পরে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এনামুল কবির নামে এক ব্যবসায়ীকে ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর বাসাবো থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। তৎকালীন ডিবির অফিসার মশিউরের নির্দেশে উঠিয়ে নেওয়া হয় তাকে। পরে চোখ ও হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয় এনামুল কবিরকে। হাত-পায়ের মাঝখানে লাঠি ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। নির্যাতন করে বিরোধী দল তথা জামায়াতের তথ্য জানতে চায়। পরে ২৬ নভেম্বর মামলা দেয় তার বিরুদ্ধে। তার অফিস থেকে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে মর্মে মামলা করে। অনেক দিন জেল খাটার পর তিনি জামিন পান। এসব বিষয়ে অভিযোগ এনে তিনি শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনের নাম উলেস্নখ করে আবেদন করেছেন।
তাজুল ইসলাম আরও জানান, বিগত সরকারের ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সব গুমের ঘটনারও তদন্ত চেয়েছেন এনামুল। আমরা এখন এটি যাচাই-বাছাই করে দেখব।
সেই ইয়ামিনের মৃতু্যতে অভিযোগ
সাভারে গুলির পর পুলিশের সাঁজোয়া যানে তুলে সেখান থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭৮ জনের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে অভিযোগ করা হয়েছে। সোমবার চিফ প্রসিকিউটর বরাবর এই অভিযোগ দাখিল করেন নিহতের মামা মোহাম্মদ আব্দুলস্নাহ আল মুন কাদির। তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন সাকিল আহমাদ।
এই আইনজীবীর অভিযোগ, গত ১৮ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে। তারা শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে ধরে টেনে পুলিশের সাঁজোয়া যানের কাছে নিয়ে বুকের বামপাশে গুলি করে। এ অবস্থায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ইয়ামিনকে টেনে পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপর ফেলে রেখে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য গাড়িটি এপাশ থেকে ওপাশ প্রদক্ষিণ করতে থাকে। ইয়ামিনকে প্রায় মৃত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেয় এবং সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে একজন পুলিশ সদস্যকে বের করে তার পায়ে পুনরায় গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই পুলিশ সদস্য ইয়ামিনকে মৃত ভেবে পায়ে গুলি না করে রাস্তার ওপরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে রোড ডিভাইডারের পাশে ফেলে দেয়। গুলিবিদ্ধ শাইখ ইয়ামিনকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচন্ড কষ্টে নিঃশ্বাস নিতে তখনো দেখা যায়। এ অবস্থায় পুলিশ সদস্যরা ধরাধরি করে উঁচু রোড ডিভাইডারের একপাশ থেকে আরেক পাশ ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গার্মেন্টকর্মী হত্যায় মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মো. ফজলু নামে এক গার্মেন্টকর্মী গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭১ জনের নামে মামলা হয়েছে। সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালতে ফজলুর স্ত্রী সুরাইয়া এই মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- শেখ রেহানা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, কামাল আহমেদ মজুমদার, হাবিবুর রহমান, কামরুজ্জামানসহ প্রমুখ। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামে ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মাজহারুল ইসলাম মারুফ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
চট্টগ্রামে আলম হত্যায় ২২৫
জনের নাম উলেস্নখ করে মামলা
আমাদের চট্টগ্রাম বু্যরো জানান, নগরের ডবলমুরিং থানার মনসুরাবাদ পুলিশ লাইনের সামনে মো. আলম নামে এক চাকরিজীবীকে হত্যার অভিযোগে সাবেক তিন মন্ত্রী, পাঁচজন সংসদ সদস্য ও আলোচিত ভূমিমন্ত্রীর সাবেক এপিএস সায়েমসহ ২২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। রোববার রাত ১১টার দিকে নগরের ডবলমুরিং মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন নিহতের ভাই মো. জামাল উদ্দিন (৫৩)।
জামাল নোয়াখালী জেলার সেনবাগ থানার মধ্যম নলুয়ার মোহাম্মদ আবদুল ছোবাহানের ছেলে। বর্তমানে তিনি নগরের কোতোয়ালি থানাধীন দামপাড়া ব্যাটারি গলিতে বসবাস করেন।
মামলায় আসামিরা হলেন- সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনিসুল হক মাহমুদ, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমএ লতিফ, চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাঁচলাইশ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চু, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. দিদারুল আলম দিদার, চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, চট্টগ্রাম ৪-সীতাকুন্ড আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুলস্নাহ আল মামুন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপস্নব বড়ুয়া, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম, চসিকের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, জাতীয় পার্টির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সোলেমান আলম শেঠ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ সালাম, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, সাবেক কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর মোবারক, সাবেক কাউন্সিলর তৌফিক আহম্মদ চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর জাফর আলম চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপস্নব, সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, সাবেক কাউন্সিলর আব্দুর সবুর লিটন, সাবেক কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর, সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল, সাবেক কাউন্সিলর এসরারুল হক, সাবেক কাউন্সিলর জহুর লাল হাজারী, ভূমিমন্ত্রীর সাবেক এপিএস রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম, দিদারুল আলম মাসুম, দেবাশীষ নাথ দেবু, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ, আরশাদুল আলম বাচ্চু, নুরুল আজিম রনিসহ ২২৫ জন।
সোমবার মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক আহমেদ। তিনি বলেন, মো. আলম হত্যার ঘটনায় থানায় ২২৫ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাত ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। মামলা নং-১৫/১৮২। মামলাটি তদন্ত করবেন থানার এসআই ইয়াছির আরাফাত।
শিক্ষার্থীর পায়ে গুলি
হাছানসহ আসামি ১৭৭
চট্টগ্রাম বু্যরো আরও জানান, নগরের মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মাদ্রাসা ছাত্র মো. সুজন (১৪) ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার ঘটনায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ১২৭ জনের নাম উলেস্নখ করে মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত আরও ৪০-৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। রোববার রাতে নগরের পাঁচলাইশ থানায় বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন সুজনের মামা মোহাম্মদ রিদুওয়ান।
ভুক্তভোগী মাদ্রাসার ছাত্র মো. সুজন নোয়াখালী জেলার সদর থানার চরমোলস্না এলাকার বেরামারা গ্রামের মো. বেলালের ছেলে। সে চান্দগাঁও এলাকার আল জামিরুল হায়াত মাদরাসায় পড়াশোনা করে।
মামলার উলেস্নখযোগ্য বাকি আসামিরা হলেন- চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, সাবেক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চু প্রমুখ।
মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়, গত ১৮ জুলাই সুজন মাদ্রাসা থেকে বাসায় ফিরছিলেন। মুরাদপুর এলাকার এন মোহাম্মদ পস্নাস্টিক শো-রুমের সামনে পৌঁছলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে অভিযুক্তদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে সেখানে গোলাগুলি শুরু হয়। ওই সময় ঘটনাস্থলে থাকা সুজন তার ডান পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হন এবং অনেক পথচারী আহত হন। পরে সুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে অপারেশন করে তার পায়ের গুলি বের করে চিকিৎসা করানো হয়।
সুজনের মামা মোহাম্মদ রিদুওয়ান বলেন, ১৮ জুলাই সংঘর্ষে আমার ভাগিনা গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে অপারেশন করে তার পায়ের গুলি বের করা হয়। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় মামলা করা হয়েছে।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান জানান, এক মাদ্রাসা ছাত্র গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ১২৭ জনের নাম উলেস্নখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত আরও ৪০-৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।