'হাসপাতাল থেকে ছেলের লাশ নিতে অনেকের হাতে-পায়ে ধরেছি, কেউ গাড়ি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত রিকশায় করে লাশ জানাজার জন্য মোহাম্মদপুর মসজিদে নিয়ে যাই। রাতেই প্রশাসনের চাপাচাপির কারণে দাফন করি। এতদিন হয়ে গেল সরকারের কেউ কোনো খবরও নেয়নি। সাহায্য সহযোগিতা তো অনেক দূরের কথা। অথচ এখন আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক শহীদের মা।'
ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেন, শহীদ মোহাম্মদ রনির (২০) মা পারভীন বেগম (৪৫)। তার ঝাঁঝালো কথায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তার সঙ্গে বসে থাকা রনির ছোট বোন মনি বেগমও (১৮) কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাইয়ের কথা স্মরণ করতেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। পুরো ঘরের পরিবেশ বিষাদে রূপ নেয়।
খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর পারভীন বেগম বলেন, 'আমার আর সুখ হলো না। এমনিতেই আমরা উর্র্দুভাষী অবাঙালি। নানা ধরনের কষ্ট আর অশান্তিতে থাকতে হয়। আমার জন্ম ঢাকার মিরপুরের কালশী উর্দুভাষী অবাঙালি বা বিহারি ক্যাম্পে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা মমতাজের সঙ্গে বিয়ে হয় অনেকটা কিশোরী বয়সেই। স্বামীর সঙ্গে মাসিক আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় একটি রুমে বসবাস করছিলাম। স্বামী দোকানে কাজ করতেন। বছরতিনেক আগে স্বামীর মৃতু্য হয়। এরপর সংসারের আয়-রোজগার অনেক যায়। তাই ছেলে রনি আর মেয়ে মনিকে নিয়ে মাসিক দেড় হাজার টাকায় জেনেভা ক্যাম্পে একটি রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলাম। অভাবের কারণে ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করাতে পারিনি। আমার একমাত্র ছেলে রনি একটি দোকানে থাকত। মাঝে মধ্যে রিকশা চালাত। আর আমি বাসায় বসে নকশী কাঁথা সেলাই করতাম।'
তিনি আরও বলেন, 'বাচ্চাদের জন্য প্রতিটি ৩ ফুট লম্বা আর দুই থেকে আড়াই ফুট প্রস্থের কাঁথা সেলাই করে পেতাম ৫০ টাকা। বড় কাঁথা সেলাই করলে প্রতিটি আড়াইশ' থেকে তিনশ' টাকা পেতাম। ছেলে আর আমার সামান্য রোজগারেই কোনোমতে সংসার চলে যাচ্ছিল। বছর দুয়েক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি জেনেভা ক্যাম্পেরই এক উর্দুভাষী অবাঙালি ছেলের সঙ্গে। তারপরও অভাব থাকলেও
ভালোই চলছিল মা-ছেলের ছোট সংসার।'
এরপরই তিনি আবার কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, 'সব শেষ হয়ে গেল চলতি বছরের ১৮ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন চরম আকার ধারণ করছিল। ওইদিন রাত দেড়টার দিকে ঢাকার শেরেবাংলানগর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে মোবাইলে কল আসে। তারা আমাদের দ্রম্নত হাসপাতালে যেতে বলেন। হাসপাতাল ক্যাম্প থেকে কাছেই। তাই দ্রম্নত সেখানে দৌড়ে যাই। গিয়ে দেখি আমার ছেলের রক্তাক্ত লাশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বারান্দায় রাখা ট্রলির ওপর পড়ে আছে। পুরো শরীর রক্তে ভেজা। বুকে কয়টা গুলি লেগেছে তা বুঝতে পারছিলাম না। তবে পুরো বুক অনেকটাই গর্ত হয়ে ছিল। বুকের মাঝ বরাবর বুলেট লেগে সোজা বেরিয়ে গেছে। পিঠের দিকে বিশাল গর্ত হয়ে আছে। সেখানে কোনো মাংস নেই। এমন অবস্থা দেখে আমি আর মেয়ে মনি এক প্রকার বোবা হয়ে যাই। আমার মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছিল না। হাসপাতালের লোকজন ছাড়াও অপরিচিত কিছু লোকজন দ্রম্নত লাশ নিয়ে যেতে তাগাদা দিচ্ছিল। লাশ নেওয়ার জন্য সেখানে থাকা এমন কেউ নেই, যাদের হাতে পায়ে ধরেনি। অথচ কেউ লাশটি নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স তো পরের কথা, একটি গাড়িও যোগাড় করে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত এক রিকশাওয়ালার হাতে-পায়ে ধরে মেয়ে আর আমি রিকশায় বসে লাশ আমাদের হাঁটুর উপর রেখে মোহাম্মদপুর মসজিদে নিয়ে যাই জানাযা নামাজের জন্য। অপরিচিত লোকজনদের চাপে রাতেই লাশ পাশের মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে অবস্থিত কবরস্থানে দাফন করি।'
পারভীর বেগম বলেন, 'আমার আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। ঘরের ভাড়া দিতে পারি না। তাই ঘর ছেড়ে দেই। কী করব, কোথায় যাবো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন পরিস্থিতিতে জেনেভা ক্যাম্পে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় পাই। মেয়ের শাশুড়ির বাসাতেই এখন থাকি। একটি মাত্র রুম। সেখানে মেয়ে ও মেয়ের জামাই থাকে। মেয়ের শাশুড়ির সঙ্গে কোনোমতে রাতে ফ্লোরে শুয়ে রাত্রীযাপন করি। অথচ আমি নাকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ মোহাম্মদ রনির গর্বিত মা। সরকারের কেউ আজও আমাদের খোঁজখবর নেয়নি। সাহায্য-সহযোগিতা তো অনেক পরের কথা। এখন পর্যন্ত একটি টাকাও শহীদ রনির মা হিসেবে পাইনি। আপনি নিজেই দেখে যান কেমন আছি আমরা। এটি কি মানুষের জীবন হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিভিন্ন জনের মাধ্যমে শুনেছি চলতি বছরের ১৮ জুলাই রাতে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ওই সময় আন্দোলন থামাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। তখন রনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাস্তায় ছিল। পুলিশের গুলি তার বুক বরাবর গিয়ে লাগে। রনি বাসস্ট্যান্ডের বাম দিকে থাকা আলস্নাহ করিম মসজিদের সামনেই লুটিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই রনি মারা যায়। তারা পুরো শরীর রক্তে ভিজে যায়। কত গুলি লেগেছে তা জানা যায়নি। হাসপাতাল থেকেও তা জানানো হয়নি। হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ আমাদের দেওয়া হয়েছে।'
এদিকে শহীদ সোহরওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ২১ জনের লাশ হস্তান্তর করার তালিকা পাওয়া গেছে। তালিকা মোতাবেক ১ নম্বরেই আছে রনির নাম। নামের পাশে যোগাযোগের মোবাইল নম্বরটিতে কল করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে রনির সন্ধান মিলে। প্রথমে জানা যায় রনির মা ঢাকার পলস্নবীতে থাকেন। সেখানে খবর নিলে জানা যায় তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে থাকেন। ক্যাম্পের অন্তত ২০ জনকে জিজ্ঞাসা করার পর রনির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। ৮ থেকে ১০ বছর বয়সি একটি শিশুর সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করা সম্ভব হয় রনির মা ও বোনকে। রনির মা বর্তমানে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ঢাকার মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের ৬ নম্বর লাইনের ৪৩৬ নম্বর বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় আছেন। ১০ দৈর্ঘ্য আর ৮ ফুট প্রস্থের ঘরটিতে রয়েছে একটি ছোট খাট। খাটের সামনেই খানিকটা জায়গা। সেখানেই রান্না হয়। রাতে হাড়ি পাতিল গুছিয়ে সেখানেই থাকেন মনির মা আর শাশুড়ি শাফিনা আক্তার (৫৮)। ঘরে সিলিং ফ্যান পর্যন্ত নেই। একটি ছোট টেবিল ফ্যান দেয়ালের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রচন্ড গরমে সেটিই একমাত্র সম্বল। সবার জায়গা বলতে একটি ভাঙা স্টিলের চেয়ার আছে। পাশেই সেলাই করার মেশিন।
শাফিনা আক্তার বলছিলেন, কী করব বলেন! একমাত্র ছেলে মারা যাওয়ার পর রনির মা একপ্রকার পাগল হয়ে আছে। কথাবার্তার ঠিক নেই। কী বলতে কী বলেন, তার মাথামুন্ডু নেই। পুত্র শোকে একেবারেই দিশেহারা। তারপর আমারও স্বামী নেই। রনির মায়ের স্বামী নেই। আমাদের ঘরটি মাসিক সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়া। ছোট ছেলে সোহেলের সঙ্গে রনির বোন মনির বিয়ে হয়েছে। বিয়ানের কষ্ট দেখে মানবিক কারণে তাকে আমাদের বাসায় থাকতে দিয়েছি। কী আর করব। আমাদেরও টানাটানির সংসার। স্বামী নেই। ছেলের রোজগার আর কিছু হাতের কাজ করে সংসার চালাই। রনি বেঁচে থাকলে হয়তো বিয়ে করে মাকে নিয়ে ভালোই থাকতে পারত। কপালে না থাকলে আর কী করার আছে। বলেই তিনিও কাঁদতে থাকেন। তার সঙ্গে সবাই কাঁদছিলেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশেহারা রনির মা শুধুই উদাস নয়নে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।